চারিদিকে যখন ঈদের আনন্দ আর খুশির জোয়ার তখন গাইবান্ধার চরাঞ্চলে বেদনার গল্প। বছর বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে নাকাল মানুষগুলোর জীবনে উৎসবের ছোঁয়া লাগে না কখনো।
প্রতিদিনের মতো পূব আকাশে সূর্য উঁকি দিলেও ঈদের সকাল হওয়ায় আজকের দিনটা ভিন্ন।
এই সকাল সবার জন্য আনন্দের ঝলকানি নিয়ে হাজির হলেও গাইবান্ধার যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে বিবর্ণ মানুষগুলোর সামনে ঈদের আনন্দ অনেকটাই স্বপ্ন। উৎসবের দিনেও পেটের তাগিদে নৌকা টানতে গিয়ে ষাটোর্ধ্ব গেদা মিয়ার পোড় খাওয়া মুখ থাকে এমনই ভাবলেশহীন। তার মতোই শিশু, নারী, পুরুষ কারো ভাগ্যেই জোটেনি নতুন জামা।
এদিকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাজে ফুলছড়ি চরে বসবাসকারী মানুষের ঈদের দিনটি কাটে অন্য দিনের মতোই, নেই কোন আনন্দ, উচ্ছ্বাস। এই গ্রামের মজিদ মিয়া স্বপ্না দম্পতি, মজিদ মিয়ার বাবার রেখে যাওয়া পাঁচ বিঘা জমিতেই চলছিল সুখের সংসার। ১৯৮০ সালে যমুনার গর্ভে ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।
কয়েক বছর পর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর সেই ভিটায় চর জাগে। তবে নতুন চরে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন আর সুখ কপালে সয়নি। ১৯৯২ সালের বন্যায় নদী ভাঙনের তীব্রতায় আবারও বসত ভিটা নদীতে বিলিন হয়ে যায়। এর পর থেকে সংসারের অভাব আর যায়নি।
১৯৯৩ সালে মাথা গোজার একটু জায়গা কিনে বসত-বাড়ি তৈরির পর ভালোই চলছিল সংসার। তবে তিন বছর পার না হতেই ১৯৯৬ সালের বন্যায় সেই বাড়িটিও যমুনার গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এরপর থেকে বন্যা আর ভয়াবহ নদী ভাঙনে বছরের পর বছর চলে জীবন যুদ্ধ। দিন মজুরের কাজ করে পেট চললেও বয়স বেশির কারণে কাজ করতে না পেরে মানবেতর চলছে জীবন।
ঈদ কেমন কাটছে জানতে চাইলে কান্না ভেজা কণ্ঠে মজিদ মিয়া বলেন, ‘ঈদের আনন্দ হামাগেরে কপালে নাই। হামাগেরে টাকা নাই, ঈদ ক্যামনে করি। হামাগেরে কপালের সুখ কেড়ে নিয়েছে যমুনা নদী। হামরা কেমন আছি আর কী করি কেউ খোঁজ নেয় না। হামাগেরে ঈদ নাই বাহে।’
মজিদ মিয়ার স্ত্রী স্বপ্না বেগম বলেন, ‘কষ্টের কথা বলতে শরম লাগে, কি যে কষ্টে আছি বাবা-মন জানে। জমিগুলো যদি থাকতো তাহলে ঘরের ভাত খেতাম। এতো কষ্ট করতে হতো না। এখন পরের জমিতে দিন মজুরের কাজ করতে হয়। এক মাস রোজা করেছি একট টুকরো মাংসও খেতে পারিনি। অনেক কষ্টে রোজা করার পর ঈদ আমারদের জন্য অভিশাপ মনে হয়। কারণ ঈদের দিন পারি না কিছু খেতে, পারি না নতুন কাপড় পরতে।’
যমুনার করাল গ্রাসে ভিটে মাটি হারানো মজিদ মিয়ার মতো হাজারও মানুষ উপভোগ করতে পারে না ঈদ আনন্দ।
গাইবান্ধার তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী বেষ্টিত প্রায় ৮২টি চরের একই চিত্র। তাদের শিশু সন্তানরা জানেই না ঈদ মানে আনন্দ। তাই তাদের জন্য প্রতিবছর ঈদ যেন এক অভিশাপের নাম।
তবে চরবাসীর অভিযোগ, সরকারিভাবে বিশেষ ভিজিডি’র চাল বরাদ্দ হলেও বরাবরের মতো এবারো তা সবার ভাগ্যে জোটেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও কখনো অভাবী এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায় না।
অবশ্য জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান জানান, সরকারিভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে জন প্রতিনিধিদের দাবি এই বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল।
টিএইচ