সাতক্ষীরার উৎপাদিত তরল দুধে চাহিদা মিটছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের। প্রতিদিন গড়ে এক লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদন হচ্ছে উপকূলীয় এই জেলায়। তবে গো-খাদ্যের দামের তুলনায় দুধের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন এখানকার খামারিরা।
খামারিরা বলছেন, আগের মতো দুধের চাহিদা নেই। মূলত চিনির দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। আগেকার দিনে দুধ-চিনির মিশ্রণে নানা রকমের মিষ্টি তৈরি হলেও এখন সেটা হয়না। চিনির দাম বৃদ্ধির ফলে মিষ্টির কারখানায় দুধের চাহিদাও কমেছে।
তাদের দাবি, দুধের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বর্তমানে অনেক খামারি কমিয়ে দিয়েছেন পশুর সংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে দেশের দ্বিতীয় তরল দুধ উৎপাদনের অবস্থানও হারাতে পারে জেলাটি বলে শঙ্কা তাদের।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলার সাতটি উপজেলায় গরুর দুধ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার টন। প্রতিদিন এক লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয় এ জেলায়। যার স্থানীয় চাহিদা ১৪ হাজার লিটার। বাকি দুধ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যার গড় বাজার মূল্য ৯১২ কোটি টাকারও বেশি।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, সাতক্ষীরায় তিন হাজারের অধিক ছোট-বড় দুধের খামার রয়েছে। এরমধ্যে সরকারের নিবন্ধিত খামার দুই হাজার ৫০০টি। এসব খামারের উৎপাদিত দুধ দিয়ে ঘি, মাঠাসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি হয়। আর এই ডেইরি শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে জেলার কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষের।
সাতক্ষীরা সদরের ঘোষপাড়া এলাকার বাসিন্দা উত্তম ঘোষ জানান, গতবছর তার খামারে গুরু ছিল ২০টি। বর্তমানে গরু আছে মাত্র ৯টি। গরু কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গো-খাদ্যর দাম বৃদ্ধি ও দুধের ন্যায্য মূল্য না পাওয়াকে দায়ী করেন তিনি।
উত্তম ঘোষের ভাষ্য, এখানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। কিন্তু আমরা খামার থেকে বিক্রি করছি মাত্র ৪২ টাকায়। বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করলে তারা দাম দেয় ৪৬-৪৮ টাকা। প্রতিদিন যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয় তা দিয়ে খামার পরিচালনা করা কঠিন।
পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার খামারি ওমর আলী জানান, তার খামারে পাঁচটি বিদেশি জাতের গরু রয়েছে। তবে বর্তমানে যেভাবে গোখাদ্যের (খৈল, ভূসি ও বিচালি) দাম বেড়েছে, তাতে খামার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
ক্ষোভপ্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পান না তিনি। তার উপর গো-খাদ্যের দামের তুলনায় দুধের ন্যায্য মূল্য না পাওয়াতে এখন খামার বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামের দুগ্ধ খামারি সমিতির সভাপতি দিবস চন্দ্র জানান, ৩৫ বছর ধরে গরু লালনপালন করছেন তিনি। বর্তমানে তার খামারে ফ্রিজিয়ান, জার্সি ও হাইয়াল জাতের গাভী রয়েছে ৪৫টি। যা থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়।
তবে বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে খামার পরিচালনা করতে গিয়ে লোকসান দিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
খামারি দিবস চন্দ্র বলেন, বর্তমানে এক কেজি সয়াবিন খৈল কিনতে খরচ হয় ৮০-১০০ টাকায়। এছাড়া ভুট্টা বা গমের ভূসি কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতিলিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা। এতে কোনরকম খরচটা উঠলেও পরিশ্রমটা ব্যর্থ।
দুধের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার আগে মিষ্টির কারখানায় দুধের চাহিদা ছিল। কিন্তু চিনির দাম বাড়ায় সেটি এখন কমেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে দুধ কিনে শুধুমাত্র ঘি তৈরি করছেন। এতেকরে অনেক খামারি দুধের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পশুর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। আর এভাবে চলতে থাকলে দেশের দ্বিতীয় তরল দুধ উৎপাদনের অবস্থানও হারাতে পারে জেলাটি।
সাতক্ষীরা বিসিক এলাকায় মিল্ক ভিটার চিলিং সেন্টারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক নভেল আক্তার বলেন, সাতক্ষীরায় মিল্ক ভিটার তিনটি দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে দৈনিক প্রায় ১০ হাজার লিটার তরল দুধ কেনা হয়। যার প্রতি লিটার ৪৮-৫০ টাকা দাম নির্ধারণ করা রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা দুধ উৎপাদনে সম্ভাবনাময় জেলা। বর্তমানে জেলায় দৈনিক প্রায় ১ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যা দেশের তরল দুধ উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। তবে এখন গোখাদ্যের মূল্য বাড়ায় অনেকে খামার করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
টিএইচ