শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১
The Daily Post

নওগাঁয় ৮০ ভাগ রাইস মিল বন্ধ ; শ্রমিকদের অসহায় জীবনযাপন

নওগাঁ প্রতিনিধি

নওগাঁয় ৮০ ভাগ রাইস মিল বন্ধ ; শ্রমিকদের অসহায় জীবনযাপন

শস্যভান্ডার খ্যাত উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় ক্রমাগত লোকসান এবং অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত ১০ বছরে প্রায় ৮০ ভাগ রাইস মিল বন্ধ হয়ে গেছে। ধার-দেনা পরিশোধের জন্য অনেক ব্যবসায়ী মিল বিক্রি করে বিকল্প ব্যবসায় ঝুঁকছেন। এদিকে একের পর এক মিল বন্ধ হওয়ায় এখানে কর্মরত প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার বেকার হয়ে পড়েছেন।

জেলা চালকল (হাসকিং) মালিকদের দাবি সরকারি নীতিমালা না থাকায় কর্পোরেট ব্যবসায়ী এবং বড় বড় চালকল মালিকদের ইচ্ছে মতো বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খুদ্র মাঝারি শ্রেণির চালকল (হাসকিং) বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বড় চালকল (অটোমেটিক) মালিকরা বলছেন তাদের কারণে নয় বরং দেশের শীর্ষ স্থানীয় কর্পোরেট কোম্পানির বাজার সিন্ডিকেটের কারণে শুধু হাসকিং মিলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয় বরং অটোমেটিক রাইস মিলের অবস্থাও ভালো নেই।

ব্যবসায়ীদের দাবি দেশে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি, সংকট পুঁজি করে অনৈতিক মুনাফার আশায় কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের খোলাবাজার থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান-চাল কেনা এবং মজুত করে বাজার সিন্ডিকেট, প্রত্যেক বছর তাদের ১০ থেকে ১৫% টাকা অনাদায়, সরকার নির্ধারিত ধান এবং চালের মূল্যে সমন্বয়হীনতা, বার বার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে চাল উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং ২৫ শতাংশ শুল্কভার নিয়ে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের নিরুৎসাহিত মনোভাব এবং ব্যাংকের চড়া সুদের কারণে শিল্পটি এখন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।

জেলা চালকল মালিকদের তথ্য অনুযায়ী নওগাঁয় ধান প্রক্রিয়াজাতে ৮০ দশকে গড়ে ওঠে প্রায় দুই হাজার হাসকিং চালকল। কালের বিবর্তনে টিকে আছে মাত্র ৩১৫টি। বাকিগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা টিকে আছে তারা আবার ঋণে জর্জরিত। অন্যদিকে ৮ থেকে ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ৭৯টি অটোরাইস মিলের মধ্যে ১১টি বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৪৪টির অবস্থা বেহাল দশা। এসবের মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ দেউলিয়া, ঋণগ্রস্ত কয়েকজন জেল হাজতে, কয়েকজন আবার ফেরারি আসামি।

সরেজমিনে নওগাঁ জেলা শহরের পিরোজপুর এলাকার মামনি অটোরাইস মিলে গিয়ে দেখা যায় এটি বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দুই বছর আগে। একই অবস্থা বাইপাস এলাকার জাহানারা অটোরাইস মিলের। শহরের বরুনকান্দি এলাকার রস্তম অটোমেটিক রাইস মিল এখন অস্তিত্বহীন। সদর উপজেলার হাপানিয়া এলাকার দিশা অটোমেটিক রাইস মিলের গোডাউন ব্যতিত মেশিনপত্রসহ সবকিছু বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছেন। 

বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে মহাদেবপুর উপজেলার নওহাটা মোড় এলাকার ছামী অটোমেটিক রাইসমিল। ঋণের জন্য আদালতে নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে মহাদেবপুর সদরের কফিল উদ্দিন রাইস মিল, বিসমিল্লাহ অটোরাইস মিল, করিম অটোমেটিক রাইস মিল। মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌড়ী এলাকার রমিছা চাল কলের সাবেক মালিক রমজান আলী বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর ধরে চাতালের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সে সময় আমার মিলে ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করত। 

গত তিন বছর আগে আমি আমার চালকল বিক্রি করে দিয়েছি। আমার পার্শ্বে যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ চাল উৎপাদনের পরিবর্তে এখন ধানের চিটা সংগ্রহ করে গুড়া ভাঙানোর কাজে মিল ব্যবহার করছেন। কেউবা আবার ব্রয়লার মুরগি চাষ করছেন।

জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘এক সময় হাসকিং চালকলগুলো লাভজনক ছিল। কিন্তু ব্যবসায় ধস ও ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে চালকলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি রাইস মিলের জন্য একজন মিলারকে প্রতিবছর ১৪ রকমের লাইসেন্স গ্রহণ এবং নবায়ন করতে হয়। এসব করতে বৈধ এবং অবৈধ ফিসহ দুই লাখ টাকা খরচ করতে হয় সঙ্গে চরম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।’

নওগাঁ অটো মেজর রাইস মিলের সাধারণ সম্পাদক মো. তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘মাত্র ৩ থেকে ৪% সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা নিয়ে এসিআই, প্রাণ, আকিজ, মেঘনা, সিটি, টিকে, নাবিল এবং স্কয়ারের মতো দেশে যেসব বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বাজারে এসে তারা বড় লটে মার্কেট থেকে ধান-চাল কিনছে। তারা চাল বাজারজাতকরণের উদ্দেশে বাজার থেকে বিশাল পরিমাণ পণ্য তুলে নিয়ে প্যাকেজিং করে ইচ্ছে মতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। 

অন্যদিকে আমাদের মতো ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ন্যূনতম ১৩% সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ধান-চাল ব্যবসা করতে হচ্ছে। অথচ একটা অটোমেটিক চাউল কল প্রতিষ্ঠা করতে চড়া সুদে (১৩%) ব্যাংক ঋণ নিয়ে সর্বনিম্ন ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা লগ্নি করতে হয়। এর ফলে মাত্র ৩ থেকে ৪% সুদে পরিচালিত ওইসব কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে নওগাঁ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শ্রেণির ব্যবসায়ীরা টিকতে পারছে না।’

নওগাঁ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর রহমান জানান, জেলায় সচল হাসকিং চালকলের সংখ্যা ৩১৫টি এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তিভুক্ত সংখ্যা ৩১৫টি। চুক্তিভুক্ত সচল অটোরাইস মিলের সংখ্যা ৭৯টি। এরমধ্যে সেদ্ধ অটোরাইস মিল ৫০টি এবং আতব অটোরাইস মিল ২৯টি। এর আগে সরকারি গুদামে ৮৮৩টি চালকল চুক্তিবদ্ধ ছিল। এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় চালকল বা অটোরাইস মিল ছিল ৫১টি এবং হাসকিং মিল ছিল ৮৩২টি।’ বন্ধ হওয়া হাসকিং চালকলগুলো বন্ধের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

নওগাঁ জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ও চালকল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টন চাহিদার বিপরীতে বছরে প্রায় ১৭ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। প্রতিদিন উৎপাদন হয় প্রায় চার হাজার ৬০০ টন চাল। ৫৫ হাজার টাকা টন হিসেবে যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। অটো এবং হাসকিং চালকল রক্ষায় দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে কার্যকর করতে হবে।

বেকার হয়ে পড়ছেন অর্ধলক্ষ শ্রমিক! চালকলের নারী শ্রমিকরা অধিকাংশ বিধবা। তাই নিরুপায় হয়ে চালকলে তারা কাজ করে থাকেন। তবে এসব শ্রমিকরা চালকলে কাজ করতে গিয়ে ছোট ঘরে (খুপড়ি) আলো-বাতাস কম, প্রচণ্ড গরমে কষ্ট করে থাকতে হয়। ফলে অধিকাংশ শ্রমিকরা অসুস্থতায় ভোগেন। আবার খাবারও স্বাস্থ্য সম্মত না। 

এছাড়া ফালগুন ও চৈত্র মাসে চাতাল শ্রমিকদের তেমন কাজ না থাকায় বাড়িতে তাদের বসে বসে সময় পার করতে হয়। আর এ সময়টা তাদের কষ্ট করে পার করতে হয় পরিবার পরিজন নিয়ে।

টিএইচ