বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি যমুনা নদী। পাবনা জেলা থেকে শুরু হয়ে সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ হয়ে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের গোয়ালন্দে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। এককালে যমুনা নদীর পানি দুকূল ছাপিয়ে উত্তরাঞ্চলে দেখা দিত ভয়াবহ বন্যা।
বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে নদী শাসনের কারণে তার স্বাভাবিক গতিপথকে সেতুর পিলারের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টি করায় উজানে অতিরিক্ত ভাঙন দেখা দেয়। যার ফলে গভীরতা কমে চর পরার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। আর এখন সামান্য জোয়ারের পানিতে কূল ছাপিয়ে বন্যা হয়ে থাকে।
সেতুর উত্তরাংশ টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের অর্জুনা, গাবসারা, ফলদা, গোবিন্দাসী, নিকরাইল ইউনিয়নের পশ্চিম সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী সিরাজগঞ্জের যমুনা।
চৌহালীর সব ইউনিয়নের সম্পূর্ণ গ্রামগুলো যমুনা নদীর বুকে জেগে উঠা চরাঞ্চল। এককালে অথৈ পানিতে থৈ থৈ করা নদী চলতি পৌষ মাস থেকেই পানি শুকিয়ে মাইলের পর মাইল ধূ-ধূ বালু চর। যমুনা সেতু তৈরির পূর্বে ভূঞাপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এই নদী।
ফেরি, যন্ত্র চালিত নৌকার মাধ্যমে নদী পাড় হয়ে উত্তর বঙ্গে যাওয়াই ছিল একমাত্র অবলম্বন। ব্যবসা বাণিজ্য খ্যাত গোবিন্দাসী বাজার তৈরি হয়েছিল যমুনা নদীর কোল ঘেষে। অতিদ্রুত নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দেখা দেয় মাছের আকাল।
এই নদীর ইলিশ, চিংড়ি, বোয়াল, পাবদা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। নদীর মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করত তারা আজ অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে। শুশুয়া, চরবিহারী, রামাইল, চরচুন্দুনী,বাসিদেবকোল, গাবসারা, গ্রামগুলোর লোকজন যেখানে নৌকায় চড়ে বাড়ির ঘাটে উঠা-নামা করত সেখানে আজ মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে চলা-চল করতে হয়।
বর্ষাকাল ছাড়াও যেখানে এ নদীতে সারা বছর পানি থাকতো সেখানে ধূ-ধূ বালু চর। নৌকা যোগে অল্প সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে যে সুবিধা মানুষ ভোগ করতো সেখানে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে নৌকার মাঝি শেখ সাদি বলেন, প্রমত্তা যমুনা আজ হাহাকার বালু চর।
অতিরিক্ত স্রোতের কারণে এই নদীতে নৌকা বাইতে সাহস পাইতাম না সেখানে আজ নৌকার হালও ধরতে হয় না এমন অবস্থা যমুনার; কি নদী ছিল আজ কি হয়ে গেছে। যে ঘাটে বড় বড় ফেরি বাঁধা থাকত সেখানে আজ গরু বাঁধা থাকে। ঝাঁকি জাল দিয়ে মাঝ ধরা রশিদ বলেন- কি আর কমু খারি ভর্তি মাছ ধরতাম আজ খালইর তলাই ভরতে পারি না। এমন মাছের আকাল। নদীতে সঠিক সময পানি আসে না, মাছও আসে না। যে নদী উজান থেকে পলি মাটি বয়ে এনে এলাকার ফসলি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করত পানির স্রোত না থাকার ফলে কৃত্রিম সার নির্ভর হয়ে পড়েছে কৃষি জমি।
নাব্যতা কমে যাওয়ায় সিরাজগঞ্জের চৌহালী, এনায়েতপুরের তলদেশে চাষাবাদ হচ্ছে বোরো ধান, সরিষা, কাউন, তিল, বাদামসহ নানা শাকসবজি। চরের বিস্তৃতি বাড়ার পাশাপাশি তা স্থায়ী চরে পরিণত হয়েছে। এক সময় যে যমুনায় খড় স্রোতের কারণে নদী পারাপারেই হিমশিম খেত স্থানীয়রা। বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে প্রমত্তা যমুনার বাঘুটিয়া, ঘোড়জান ও উমারপুর অংশের। সরেজমিনে গিয়ে এমনচিত্র দেখা গেছে।
সেখানে এখন প্রায় পানি শুন্য, জেগে উঠা চরগুলোতে চাষাবাদ করছে চরাঞ্চলের চাষিরা। ফলে এখানে মানুষের বসতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। এর সঙ্গে সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গরু-মহিষের খামার। এতে পাল্টে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলের অর্থনীতি। শত শত একর জমিতে শোভা পাচ্ছে বোরো ধানের চাষ। আজ থেকে ২০ বছর আগেও যমুনার তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। তখন কেউ চিন্তাও করতে পারেনি যমুনার বুকে এক সময় চাষাবাদ হবে।
কিন্তু যমুনা নদীতে ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এর তীব্রতা কমতে থাকে। যমুনার বুক এখন ফসলে ভরা। জেগে উঠা ধু-ধু বালুচরে এখন উঠতি বোর ধানের শোভা পাচ্ছে। চলতি বছরে ১২৫ হেক্টর পরিমাণ জেগে ওটা চরে স্থানীয় বোরো, গম, মসুর, খেসারীসহ রবি শস্যগুলো আবাদ হয়েছে।
এ বিষয়ে চৌহালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জাহিদুল ইসলাম জানান, সঠিক সময়ে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যমুনার হারানো গৌরব ফেরাতে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ। এদিকে নাব্যতা সংকটের ফলে বাড়তি জমির ফসল যেন নির্বিঘ্নে কেটে কৃষক ঘরে নিতে পারে সেদিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ সাব্বির আহমেদ সিফাত।
টিএইচ