মৎস্যভান্ডার খ্যাত নেত্রকোণার হাওরঞ্চল এখন দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। এক যুগ আগেও নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। অভয়াশ্রম না থাকা, অপরিকল্পিত জলমহাল ইজারা দেয়া, নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ নিধন, ফসলী জমিতে মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে এখন আর আগের মতো হাওরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র অনুযায়ী, এক সময় চারদিকে থঁই থঁই করা হাওড়ে ছিল অঢেল মাছের মেলা। এখন আর আগের মতো নেই জলাশয়ের সেই টইটম্বুর অবস্থা, নেই মাছের বৈচিত্র্যময়তা। নেত্রকোণার বিভিন্ন হাওরের মিঠা পানিতে আর দেখা মেলে না বিভিন্ন প্রজাতির পরিচিত মাছের।
এক যুগ আগে হাওরে ২৫৩ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও এখন বিলুপ্তির পথে রয়েছে অন্তত ৬৪ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতিকে সংকটাপন্ন ও ৯ প্রজাতির মাছকে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সরকারিভাবে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংগ্রহের জন্য কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।
তবে হাওরের পানিতে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ পুণরায় অবমুক্তকরণসহ নানা প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানান মৎস্য কর্মকর্তারা।
কয়েকজন মৎস্য কর্মকর্তা জানান, নেত্রকোণার হাওর-বিলগুলোতে এখন আর আগের মতো দেশি মাছ মেলে না। বর্তমানে হাওরে দেশী মাছের মধ্যে ‘মহাবিপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, চাকা, বাঘাইড়, রিঠা, রানি, পাঙাশ, বামোশ, নাপ্তানী, চিতল, একথুটি, মহাশোল ও সরপুঁটি মাছ। ‘সংকটাপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে বাচা, ছেপ চেলা, ঢেলা, বাঁশ পাতা, কুঁচে, নাপতে কই, রায়েক, কাক্কিয়া, টেংরা, ফলি, গুজি আইড় মাছ। ‘বিপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে গোলসা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড় বাইম, গজার, তাঁরা বাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা, কালিবাউস, নান্দিনা, ঘোড়া, মধু পাবদা, খাশ খাইরা, এলং, তিলা শোল, খলিশা, বেদুরী, মেনি, শালবাইম, রায়েক ও গাং মাগুর মাছ।
মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের মল্লিকপুর গ্রামের জেলে চন্দন বর্মণ ও শ্যাওড়াতলী গ্রামের নিপেন্দ্র বর্মন বলেন, তারা পৈতৃক সূত্রে মাছ ধরা ও বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক যুগ আগেও তারা যেসব মাছ হাওর থেকে ধরতেন, এখন সে সবের বেশির ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনা জেলায় ছোট বড় ১২টি নদী, ৬৬টি হাওর, ৪৫৬টি বিল ও ১৮৩টি খাল রয়েছে। ৪৮,৯১৩.২৯ হেক্টর হাওর, বিল ও জলাশয় রয়েছে। এসব উৎস থেকে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ৭২ দশমিক ৯১ টন মাছ আহরণ করা হয়। তবে এক দশক আগে মাছ আহরণের পরিমাণ আরও বেশি ছিল। কারন জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশি প্রজাতির অনেক মাছের বংশবিস্তার হচ্ছে না। আগের মতো হাওরে পর্যাপ্ত পানি না থাকা, ‘পাইল ফিশিং’ (দু-তিন বছর নির্দিষ্ট এলাকায় মাছ না ধরা) না হওয়া এবং হাওরে নতুন পানি আসার সময় কারেন্ট জাল ও চায়না বাইর দিয়ে অবাধে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা ধরার কারণে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে কিছুদিন পর হাওরগুলো মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে।
খালিয়াজুরী উপজেলার বল্লভপুর মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি রবি চন্দ্র দাস বলেন, ‘নদী, খাল, বিল, হাওর ভরাট হয়ে যাওয়া ও পানি শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় এখন অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে কিছু খামারি তাদের ফিসারির মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কই, টেংরা ইত্যাদি জাতের মাছের চাষ শুরু করলেও তার স্বাদ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের মতো সুস্বাদু হয় না এবং হাওরের মিঠা পানির দেশীয় মাছের মতো চাহিদাও নেই এসব মাছের।
এ বিষয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞ মাসুদ আলম খান বলেন, ‘মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্তি ঠেকাতে হাওরের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মা মাছের নির্বিঘ্নে বড় হওয়া ও প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি উন্মুক্ত জলাশয়, বিল ও নদীতে অভয়াশ্রম স্থাপন করা প্রয়োজন। এক কথায় মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল তৈরি করতে না পারলে কোনোভাবেই মাছের বিলুপ্তি রোধ করা সম্ভব হবে না।
নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহ্জাহান কবীর বলেন, ‘হাওরে নতুন পানি আসার সময়টুকু অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মাছ আহরণ একেবারে বন্ধ রাখতে পারলে দেশি মাছের বিলুপ্তি কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব।
এ ছাড়াও অনেক সময় আইন অমান্য করে শুকনো মৌসুমে বিল-জলাশয় সেচে ইজারাদাররা মাছ আহরণ করে থাকেন। এটি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারলে মাছের বিলুপ্তি অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব হবে। বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করার জন্য হাওরে মাছের অভয়ারণ্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তা বাস্তবায়ন হলে এসব বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ আবারও হাওরের খুঁজে পাওয়া যাবে’।
টিএইচ