সিলেটের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতায় মাতবে পর্যটকরা। সমতল ভূমির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে খেলা করছে সাদা মেঘ। বৃষ্টি হলে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারার জলে চিকচিক করে সূর্য। অনতিদূরে হাওর, হাওরের বুকে নানা জাতের পাখির ডুবো ডুবো খেলা। পাহাড়-সমতল-জলাভূমির এমন অপূর্ব সৌন্দর্যের দেখা মেলে কেবল মাত্র সিলেটে। এ অঞ্চলের মাটির নিচে প্রকৃতি যেমন লুকিয়ে রেখেছে মূল্যবান খনিজ সম্পদ, তেমনি উপরে মেলে ধরেছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। আর শাহজালাল (রহঃ) চরণ স্পর্শে এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছায়াময় পরিবেশ। কমলা লেবু আর চায়ের পাতার ঘ্রাণ পাগল করে তোলে তাদের হৃদয়। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা এ জনপদের মানুষের কণ্ঠে তাই খেলা করে শুধু প্রকৃতিরই সুর। সব মিলিয়ে হাজার বছরের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে লালিত এ জনপদ তাই সারা দেশের কাছে পরিচিত পর্যটন এলাকা হিসেবে।
জৈন্তাপুরঃ পান-পানি, নারী এই তিনে জৈন্তাপুরী। মেঘালয়ের পাদদেশে উঁচু-নিচু পাহাড় আর সমতল ভূমি নিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি জৈন্তাপুর। এই জনপদে রয়েছে প্রকৃতি ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। এখানকার রূপ ও বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য নদ-নদী। যার বেশির ভাগ উৎপত্তিস্থল ভারতের মেঘালয় রাজ্য। তবে নদ-নদীগুলো যথাযথভাবে খনন না হওয়াতে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির ফলে প্রবল বন্যা আর শীত মৌসুমে পানি শূন্যতা দেখা দেয়। তার পরও সারী নদীর স্বচ্ছ পানি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মুগ্ধ করে তুলে। সারী নদীর উজানে লালাখাল এলাকা প্রতিদিন পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে। জৈন্তাপুরের নীলাদ্রী নামে পরিচিত লালাখালের সীমান্তবর্তী জিরো পয়েন্ট, লালাখাল চা বাগান যে কোন বয়সী মানুষকে আকৃষ্ট করে। হরিপুরের গ্যাস ফিল্ড এলাকায় একটি পাহাড়ের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা দেখতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লেগেই থাকে। এছাড়াও শ্রীপুর, রাংপানি নদী, লাল শাপলার বিল, সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র, জাফলং ভ্যালী বোর্ডিং স্কুল এবং উপজেলা সদর সহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক জৈন্তা রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দেখা মেলে।
জাফলংঃ সিলেটে বেড়াতে এসে পর্যটকরা সীমান্তে ওপারের বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন খুব সহজেই। প্রকৃতিকন্যা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাফলং বেড়াতে এসে পর্যটকরা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান খাদিম রেইন ফরেস্ট, মায়াবি ঝর্ণা, তামাবিলস্থ গ্রিনপার্ক এবং পাহাড়, নদী ও জলধারার অপূর্ব মিশেল পাংথুমাইয়ে। আর বাড়তি পাওনা-বর্তমানে দেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রাতারগুল। এশিয়ার ২৬টি জলাবনের অন্যতম গোয়াইনঘাটের রাতারগুল না দেখলে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সিলেটজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোও ভিন্নভাবে আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাসুদেরকে। জাফলং ডাউকি নদীর জিরো পয়েন্টে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের আগম ঘটে বিশেষ দিনগুলোতে। পাথর ব্যবসা বন্ধ থাকলেও পর্যটকদের সরব উপস্থিতিতে নানা রকম ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে। সোনাটিলা এলাকায় ছোট-বড় রেস্টোরেন্ট’র পাশাপাশি আশ-পাশ এলাকায় ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট।
নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী: নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা সিলেটের পর্যটন ক্ষেত্রকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সিলেটে বসবাসকারী খাসিয়া, গারো, লালেং বা পাত্র, চা শ্রমিক, ওরাঁও সম্প্রদায়ের জীবন বৈচিত্র্য বর্ণিল করেছে এখানকার পর্যটনকে। মাতৃতান্ত্রিক খাসিয়া সম্প্রদায় ও চা শ্রমীকদের জীবন-জীবিকা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। ওরাও, লালেং ও চা শ্রমিকদের মাটির তৈরি আর খাসিয়াদের মাচার উপর তৈরি ঘর দেখে পর্যটকরা বিমোহিত হন। খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের পরিধেয় পোশাকও ভিন্ন। সে পোশাকের চাহিদা রয়েছে বাঙালি ললনাদের মাঝেও। সে চাহিদা কেবল সিলেটের সীমানাতেই আটকে থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। তাদের পুরুষরা পরিবারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে থাকে। এত সব রূপ বৈচিত্র্যের অধিকারী বৃহত্তর জৈন্তার প্রকৃতি ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো আরো সমৃদ্ধশালী হবে আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবসে এই প্রত্যাশা জৈন্তাবাসীর।
এব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনা (ভূমি) রিপামনি দেবীর সাথে আলাকালে তিনি বলেন জৈন্তাপুর উপজেলা সত্যিই পর্যটন সমৃদ্ধ এবং ঐতিহাসিক একটি জনপদ। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে লাল শাপলা বিলে একটি পিকভিউ এবং সারী নদীর লালাখাল পয়েন্টে দৃষ্টিনন্দন ঘাট সহ পর্যটন সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে পর্যটকরা যেমন আকৃষ্ট হবে, তেমনি এই এলাকার জীবন-মান আরো উন্নত সহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।
এসএম