প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনী জেলায় দিন দিন বাড়ছে হুন্ডি ও বিকাশের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ। যত্রতত্র হুন্ডি কারবার ও সহজলভ্য বিকাশের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় জেলায় প্রকৃত রেমিট্যান্সের হদিস মেলাতে পারছে না সরকারি সংস্থাগুলো।
যদিও এরই মধ্যে জেলার ১৬ কারবারির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে সিআইডি। আরও অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংস্থাটি।
ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভূত এসব লেনদেনের কারণে জেলায় বেড়েছে কালো টাকার প্রবাহ ও নেতিবাচক প্রভাব। দ্রুত ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেন বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা না নিলে প্রবাসীরা অবৈধ এ কারবারে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সমপ্রতি এ বিষয়ে সারাদেশে অর্থনীতি গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করলেও ফেনীতে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম অবস্থান দখল করে রেখেছে ফেনী। এ জেলার লাখ লাখ বাসিন্দা প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন। যাদের মাধ্যমে অর্জিত রেমিট্যান্সের সমৃদ্ধিতে ফেনী এখন দেশের অগ্রসরমান জেলা।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনী থেকে যে হারে প্রবাসে শ্রমিক যাচ্ছে; সে হারে ফেনীতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসছে না। এতে সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি জেলার সামগ্রিক উন্নয়নে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শুধু তাই নয়, ব্যাংকবহির্ভূত রেমিট্যান্সের টাকায় ফেনীতে গড়ে ওঠেছে একধরনের কালোবাজারি। যাদের টাকার ছড়াছড়িতে ফেনীতে একধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রবাসীরা বলছেন, যেকোনো ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে চাইলে নির্ধারিত ব্যাংকে গিয়ে কারেন্সি জমা দিতে হয়। ওই কারেন্সির টাকা দেশের যেকোনো ব্যাংক থেকে তুলতে ৪-৫ দিন সময় লাগে। টাকা তোলার জন্য প্রবাসীর পরিবারকে নির্ধারিত ব্যাংকে যেতে হয়।
এতে একদিকে সময়ক্ষেপণ হয়, অন্যদিকে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। কিন্তুু হুন্ডিতে অথবা বিকাশে টাকা পাঠাতে সময় লাগে না। ওই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসীর ঘরে গিয়ে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে টাকা পাঠালে একদিকে বিড়ম্বনার সম্ভাবনা থাকে না; অন্যদিকে ওই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপকের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়।
তাদের দাবি, এজন্য প্রবাসীরা বিশেষ করে পরিবারের মাসিক খরচের টাকা বিকাশ ও হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে ফেরাতে সরকার নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। দেশের যেকোনো ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে এক লাখে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তারপরও ব্যাংকিং চ্যানেলবহির্ভূত রেমিট্যান্স আসা দুঃখজনক বিষয়।
তারা জানান, এ থেকে প্রবাসীদের বের করে নিয়ে আসতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে।
কামরুন নাহার নামের একজন প্রবাসীর স্ত্রী জানান, তাদের পরিবারের মাসিক খরচের জন্য প্রতিমাসে তার স্বামী আবুধাবি (সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী) থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠান। প্রথম দিকে এ টাকা একটি এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো। কিন্তু এজেন্ট ব্যাংক থেকে টাকা পেতে ৪-৫ দিন সময় লেগে যায়। যে কারণে গত ২-৩ বছর ধরে তার স্বামী তাদের নিকটাত্মীয়ের কাছে বাড়ির জন্য টাকা দেন।
তিনি আরও বলেন, তারা পরদিনই ওই টাকা বাড়িতে পৌঁছে দেন। এতে দ্রুত টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিড়ম্বনামুক্ত হওয়া যায়। সৌদি প্রবাসী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা পাঠালে দেশের ক্ষতি তা আমি জানি। কিন্তুু আমার পরিবারে পুরুষ কোনো সদস্য নেই। বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা-মা এবং স্ত্রী রয়েছেন। তাদের পক্ষে ব্যাংকে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। তাই বাধ্য হয়েই বিকাশে অথবা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বাধ্য হই।’
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রবাসীর বাড়িতে টাকা পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম চালু করতে হবে। অন্যথায় মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়তে পারে।
এদিকে প্রশাসন থেকে দাবি করা হচ্ছে, ফেনীসহ সারাদেশে অবৈধ হুন্ডি ও বিকাশের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসছে কি না এ বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান। বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স লেনদেন হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে মাঠে কাজ করছে দেশের অর্থনীতিবিষয়ক তদন্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিএফআইইউর তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তবে বিকাশের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার অভিযোগ বারবার প্রত্যাখ্যান করে আসছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। একই দাবি করে আসছেন ফেনীতে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর রাজীব চৌধুরী।
ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিআইডি) মিজানুর রহমান বলেন, বিএফআইইউর দেয়া প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ফেনীর ১৬ হুন্ডি কারবারির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে সিআইডি। আরও অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক তায়েবুল হক বলেন, মূলত ডলার ক্রাইসিস টাইমে হুন্ডি ও ডিজিটাল হুন্ডির সঙ্গে জড়িতরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তারা সরাসরি দালালের মাধ্যমে প্রবাসীদের থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেশে থাকা তাদের সহোচরদের মাধ্যমে তা প্রবাসীর ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে লেনদেনে রাষ্ট্রবঞ্চিত হয় আর কালোবাজাররিরা লাভবান হয়ে থাকেন। ডলার ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের আগে প্রকৃত অর্থে এ সমস্যা বন্ধ হবে না।
অধ্যাপক তায়েবুল হক বলেন, দেশে অসৎ লোক বেড়ে যাওয়ায় এসব সমস্যা প্রতিষ্ঠানিক আকার ধারণ করা শুরু করেছে। তবে সরকারকে এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। অন্যথায় এসব অবৈধ লেনদেনের বিস্তার ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
টিএইচ