নরসিংদীর আঞ্চলিক দুই মহাসড়ক যথাযথ মানে প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় ৩৬ মাস। এর মধ্যে ২৪ মাস পার হয়ে গেছে। এই সময়ে দুটি সড়কে ৬৬.৬৬ শতাংশ কাজ হওয়ার কথা থাকলে একটিতে হয়েছে ৩০ শতাংশ। অপরটিতে ১২ শতাংশ। সড়ক গুলোর ওপর বৈদ্যুতিক খুঁটি থাকার কারণেই কাজের এই ধীরগতি।
এরই মধ্যে সড়ক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিদ্যমান বৈদ্যুতিক খুঁটি সরিয়ে দিতে অনুরোধ জানালে বিপরীত চিঠিতে পল্লীবিদ্যুৎ লাইন স্থনান্তর ও পুনর্নির্মাণের শর্ত দিয়ে প্রাক্কলন ব্যায় ৪১ কেটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার টাকা চেয়ে বসে। বিদ্যুৎ বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী খুঁটি সরানো বাবদ গতবছরের ২০ জুন নরসিংদী সওজ বিভাগ সমুদয় টাকা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ নরসিংদীকে প্রদান করেন।
অভিযোগ উঠেছে, খুঁটি সরানোর টাকা এক বছর আগে পেয়েও নামকাওয়াস্তে কিছু খুঁটি সরিয়ে বাকি খুঁটি সরাতে খামখেয়ালিপনাও সময় ক্ষেপণ করে বছর পার করে দিয়েছে এই দপ্তরটি। এতে খুঁটিতেই আটকে আছে আঞ্চলিক দুই মহাসড়কের ৫৪.৮০ কিলোমিটারের ৯৮৪ কোটি ৮৪ লাখ বাহাত্তর হাজার টাকার সড়ক সম্প্রসারণ কাজ।
এর মধ্যে ইটাখোলা-মঠখোলা-কটিয়াদী সড়ক (আর-২১১) অংশের প্রায় ৩২.৭ কিলোমিটার ও নয়াপাড়া- আড়াইহাজার-নরসিংদী রায়পুরা সড়ক (আর-১১৪) অংশের ১৮.১০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে এমন প্রতিবন্ধকতা ও সঙ্কট সৃষ্টির হয়েছে। ফলে সড়কগুলো দিয়ে যাতায়াত করতে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা। জনমনে বাড়ছে ভোগান্তি বাড়ছে ক্ষোভ। এমনই অভিযোগ উঠেছে, নরসিংদী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ এর বিরুদ্ধে।
তবে, এসব অভিযোগ কিছুটা স্বীকারও করেছেন নরসিংদী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার শেখ মানোয়ার মোরশেদ । তিনি বলেন, টাকা জমা দিয়েছেন ঠিক আছে,টাকা পেয়েছি কাজ ও চলমান আছে। ধীরে হলে ও খুঁটি সরানোর কাজ চলছে। এক্সেন সাহেবেরে ডিজাইন অনুসারে কোনটা কোনটা জরুরী কাজ এটা আমরা করে যাচ্ছি। মালামাল ক্রয় করতে হয়। সংগ্রহ করতে হয়। এটারও একটা নিয়ম আছে। মালামাল সংগ্রহ করছি, ঠিকাদার দিয়েছি তারা কাজ করছে। আশা করি আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, সড়ক থেকে খুঁটি সরানোর বিষয়ে প্রায় দুই বছর বছর আগে থেকে অনেক চিঠি দেয়া হয়েছে। বৈঠকে বসা হয়েছে একাধিকবার। চাহিদা মত একবছর আগে লাইন স্থনান্তর ও পুনর্নির্মাণের টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে। এতেও কাজ হচ্ছে না। এ খুঁটি সরছে না।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১৯ জুলাই নরসিংদী সড়ক বিভাগের আত্ততায় ইটাখোলা-মঠখোলা-কটিয়াদী সড়ক (আর-২১১) ও নয়াপাড়া-আড়াইহাজার-নরসিংদী-রায়পুরা (আর-১১৪) দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মানে প্রশস্ততায় উন্নতিকরণ প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। জিওবির অর্থায়নে ৫৪.৮০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে প্রকল্পটির মোট ব্যায় ধরা হয় ৯৮৪.৮৪৭২ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির অনুমোদতি মেয়াদ ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত। প্রকল্পে সড়ক দুটি ৪টি প্যাকেজে ভাগ করে চারটি অংশে পৃথক দরপত্র আহ্বান করা হয়। সড়কগুলো চওড়া হবে ৩৪ ফুট। সড়কের গুরত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে একাধিক আন্ডারপাস,ওভারপার,সাইড রোড, সেতু ও ড্রেন নির্মাণ করা হবে।
এর মধ্যে ইটাখোলা-মঠখোলা-কটিয়াদী আঞ্চলিক (আর-২১১) সড়কটি দুটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। প্যাকেজ-০১ ইটাখোলা মোড় হতে দশদোনা মোড় ১৬.০০ কিলোমিটার সড়ক রিলাইয়াবল বিল্ডার্স লিমিটেড ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করছে। যার চুক্তি মূল্য ধরা ২৪১.৯৩ কোটি টাকা। কাজটি মেয়াদ : ১৬/১০/২০২৩ হতে ১৫/১০/২০২৫ ইং শেষ হবে। কাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ।
ওই প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আজাদ রহমান বলেন, ৯ মাস আগে আমাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিছুু আন্ডারপাস,ওভার পাস ও সাইড রোড করা হয়েছে। সড়কে প্রধান বাধা সৃষ্টি করছে বৈদ্যুতিক খুঁটি তাই কাজে ধীরগতি। এগুলো সরানো হচ্ছে না বলে কাজও করতে পারছি না।
একই সড়কের প্যাকেজ-০২ দশদোনা মোড় হতে ড্রেনের ঘাট ১৬.৭০ কিলোমিটার সড়ক ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড করছে। যার চুক্তি মূল্য: ৩০২.৮০ কোটি টাকা। কাজের মেয়াদঃ ০৭/১২/২০২৩ হতে ০৭/১২/২০২৫। কাজের অগ্রগতি৩০ শতাংশ। তবে এর মধ্যে সাগরদি হতে ড্রেনের ঘাট পর্যন্ত মোট ৩.৫০ কিলোমিটার সড়কের পার্শ্ব হতে গড়ে ৩৫ ফুট করে ৪০.৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫.২৬ হেক্টর ভ‚মি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। প্যাকেজ-০৪ এ ৪.০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাতরদিয়া-দশদোনা সংযোগ সড়কটি একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করছে। যার চুক্তি মূল্য ২৮ কোটি টাকা। কাজের মেয়াদঃ ১০/০৪/২০২৩ হতে ১০/১০/২০২৫ ।
ইতিামধ্যে প্যাকেজ-৪ কাজটি শেষ করেছে ঐ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, সড়কের মধ্যে শত-শত খুঁটির কারণে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। খননযন্ত্র দিয়ে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। কিছু দূর পরপর রাস্তা,আন্ডার পাস,ওভার পাস বা ড্রেনের মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুঁটি থাকায় কাজে ধীরগতি। এর ফলে ওই সড়কে যাতায়াত করতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা।
প্যাকেজ-০৩ নরসিংদী-রায়পুরা (আর-১১৪) ১৮.১০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে কাজ করছে রানা বিল্ডার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার চুক্তি মূল্য ২৪৯.৩৫ কোটি টাকা। কাজের মেয়াদঃ ০৭/১২/২০২৩ হতে ১০/১০/২০২৫ । কাজের অগ্রগতি ১২ শতাংশ। ওই সড়কের কিছু অংশ ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।
দায়িত্বে থাকা প্রজেক্ট ম্যানেজার সোহেল রানা বলেন, রাস্তার মাঝে ৪৮০ টি খুঁটি রয়েছে। অনেক বলাবলি ও অনুরোধের পর পল্লী বিদ্যুৎ মাত্র ২০ টি খুঁটি সরিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে আমাদের কাজ ৪০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। এগুলো সরানো হচ্ছে না বলে কাজও করতে পারছি না। বৈদ্যুতিক খুঁটি না সরানোর কারণে আমরা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারব না। খুঁটি সরানো না গেলে লোকসান ক্রমাগত বাড়বেই।
নরসিংদীর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাজীব কুমার দাস বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী খুঁটি সরানো বাবদ এক বছর আগেদ সড়ক বিভাগ ৪১.৬৮ কোটি টাকা,পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২,নরসিংদীকে প্রদান করে। আমার ইটাখোলা-মঠখোলা-কটিয়াদী আঞ্চলিক (আর-২১১) অংশে প্রায় ১৮৬৯ টি খুঁটির মধ্যে মাত্র ২৫০ টি খুঁটি সরিয়েছে। এক বছরে গড়ে খুঁটি সরানোর হয়েছে মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। ধীর গতিতে খুঁটি স্থানান্তরের কারণে মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শিবপুর কলেজগেট, শিবপুর বাসস্ট্যান্ড, সিএন্ডবি, হাতিরদিয়া,নারান্দি, মনোহরদীসহ হেতেমদি বাসস্ট্যান্ড এ আন্ডারপাস এবং সেতু নির্মান কাজ বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২, চৌয়ালা, নরসিংদীকে বার বার অবগত করা হলেও খুঁটি স্থানান্তরে দ্রুততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হচ্ছে।
আঞ্চলিক মহাসড়ক দুইটির পুরোপুরি কাজ শেষ হলে সড়কগুলো ব্যবহার করে বর্তমানে জনসাধারণ নির্বিঘ্নে ও স্বল্প সময়ে যেমন যাতায়াত করতে পারবেন গন্তব্যে, তেমনি পণ্য পরিবহন ও করতে পারবেন খুব সহজেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্মোচিত হবে নতুন এক দিগন্তের। দেশীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতে রুটটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই বিদ্যুতের খুঁটি অতি দ্রুত স্থানান্তর করে প্রকল্পটি যথা সময়ে বাস্তবায়ন করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী জনসাধারণ।
টিএইচ