সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
The Daily Post

মহেশপুর সীমান্তে তিন মাসে মানব পাচারের সময় আটক ৩৫৩

মহেশপুর (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি

মহেশপুর সীমান্তে তিন মাসে মানব পাচারের সময় আটক ৩৫৩

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে ইছামতি নদী। বেশ কিছু এলাকায় ভারতীয় অংশে নেই কাঁটাতারের বেড়া। সুযোগ সন্ধানী কিছু অসাধু ব্যক্তি ও চোরাকারবারিরা সীমান্তের কাঁটাতার বিহীন অংশে মানুষ পাচারসহ অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ব্যবহারের চেষ্টা করে। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সীমান্তের প্রতিটি এলাকায় জোরদার করা হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। 

ফলে বিজিবির অভিযানে প্রায়ই আটক হচ্ছে সাবেক মন্ত্রী, হত্যা মামলার আসামি, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালের মাধ্যমে ভারতে পাচারের চেষ্টারত নারী-পুরুষ ও দালাল এবং ভারতীয় নাগরিক।

সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাটিলা, বাঘাডাঙ্গা, খোশালপুর, ভবনগর, সামন্তাসহ সীমান্তের কাটাতারবিহীন এলাকা দিয়ে ঘটছে বাংলাদেশি নারী-পুরুষ, রোহিঙ্গা পাচার ও পাচারের চেষ্টা। তারা সন্ধ্যা, মধ্যরাত ও ভোররাতের সময়কেই বেছে নেয় সীমান্ত পারাপারের জন্য।

স্থানীয়রা বলেন, সীমান্ত থেকে একটু দূরের মানুষ অবৈধ পাচারের সঙ্গে জড়িত, কারণ সীমান্ত এলাকায় বিজিবির হাতে আটকের ভয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এনে নিজেদের জিম্মায় রেখে রাতে নদী সাঁতরিয়ে ভারতে পাচারের চেষ্টা করে।

জানা যায়, এসব পাচারের কাজের মূল হোতারা থাকেন যশোর জেলার চৌগাছা ও ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা শহর ও আশপাশের এলাকায়। তাদের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকার দালালরা ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ভারতে নারী-পুরুষ পাচারের জন্য বাহক হিসাবে কাজ করে।

বিজিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহের মহেশপুরের ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা রয়েছে ৭৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে সাড়ে ১০ কিলোমিটার অংশে খণ্ড খণ্ড আকারে ভারতের অভ্যন্তরে নেই কাঁটাতার। ফলে কাঁটাতারবিহীন অংশে মানুষ পাচারসহ অপরাধমূলক কাজের প্রবণতার চেষ্টা থাকে বেশি। অন্য এলাকার সঙ্গে এসব অংশে দিনে ও রাতে আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ বিজিবির টহল ব্যবস্থা, চলছে নিয়মিত তল্লাশি।

ফলে চলতি বছরের ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভারতে পাচারের চেষ্টার সময় ৩৫৩ জনকে আটক করেছে বিজিবি। এর মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ, ঢাকা মহানগরের ৩৮নং ওয়ার্ড যুবলীগের কর্মী ও হত্যা মামলার আসামি কিলার অনিক, ৯ জন দালাল, ১০ ভারতীয় নাগরিক, ১০ জন রোহিঙ্গা এবং শিশুসহ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ ২৯৬ জন। যা আটকের হারে গত এক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। 

গতবছরের ১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৯শ মানুষকে পাচারের চেষ্টার ঘটনায় আটক করে বিজিবি। ভারত থেকে আসার সময়ও অনেকে আটক হয়। এদের মধ্যে বাংলাদেশি, ভারতীয় নারী-পুরুষ ছিল। সেসময় পাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত অনেক দালালও আটক হয়। তবে পাসপোর্ট অধ্যাদেশ আইনের দুর্বলতা সীমান্তে অবৈধ পাচার রোধে অন্যতম অন্তরায় বলে দাবি করেন সিনিয়র আইনজীবীরা। 

চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তের মাটিলা এলাকায় বিজিবি-৫৮ ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সঙ্গে ৬৮ ও ৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএসএফের পক্ষ থেকে জানানো হয় গেল দুই মাসে সীমান্তে কমেছে পাচারের ঘটনা। সাধারণত বাংলাদেশিরা পাসপোর্ট বিহীন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের যাওয়ার চেষ্টার সময় বিজিবির হাতে আটক হলে তাদের ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট অধ্যাদেশ আইনে মামলা করে থানায় সোপর্দ করা হয়।

এই আইনে সাজা তিন মাস কারাদণ্ড অথবা ৫শ টাকা জরিমানা। ফলে আদালতে আসামিরা জামিন ধরলে সঙ্গে সঙ্গেই জামিন হয়ে যায়। এছাড়া কোন বিদেশি নাগরিক বা ভারতীয় নাগরিক যদি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে আটক হয় তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ‘দি কন্ট্রোল অফ এন্ট্রি এ্যাক্ট-১৯৫২’ আইনে মামলা করে থানায় সোপর্দ করা হয়। 

সামপ্রতিক সময়ে বিজিবির অভিযানে আটক কক্সবাজার রোহিঙ্গা পল্লীর এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, জুলুলী এলাকার রবিউলের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান ১৮ হাজার এবং বাংলাদেশি ৫ হাজার টাকায় সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেবে এমন চুক্তি হয়েছিল। পরে রাতে বিজিবি আমাদের আটক করে। 

ঝিনাইদহের মহেশপুর বিজিবি-৫৮ ব্যাটালিয়নের পরিচালক শাহ মো. আজিজুস শহীদ বলেন, আগের তুলনায় সীমান্তে অবৈধ পাচার কমেছে কয়েকগুণ। বিজিবি নজরদারিতে পদ্ধতি বদলেছে। যার সফলতাও আসছে। পাচার রোধে ভারত অংশে কাঁটাতার নির্মাণে বিএসএফ এর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। 

ঝিনাইদহের সিনিয়র আইনজীবী শেখ আব্দুল্লাহ মিন্টু বলেন, আইনের মাধ্যমে মানুষকে সাজা দেয়ার মানেই হল নজির স্থাপন করা বা ভীতি সঞ্চার করা। যাতে করে দণ্ডিত ব্যক্তি বা অন্য যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা এটা দেখে ভয় পায় এবং ভবিষ্যতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসে।

বিভিন্ন মামলার তথ্যসূত্রে জানা যায়, মহেশপুর উপজেলার জলুলী গ্রামের সীমান্ত এলাকার শতাধিক দালাল রয়েছে যারা মানব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এদের বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন (আরডিসির) নির্বাহী প্রধান আব্দুর রহমান বলেন, মামলার আসামিদের আটক করতে পারলে সীমান্তের মানব চোরাচালান অনেকটাই কমে আসবে।

টিএইচ