শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
The Daily Post

মাগুরা কোটি টাকার ইজিপিপি প্রকল্পে শুভঙ্করের ফাঁকি! 

মাগুরা প্রতিনিধি

মাগুরা কোটি টাকার ইজিপিপি প্রকল্পে শুভঙ্করের ফাঁকি! 

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫১টি প্রকল্পের কাজ কাগজে-কলমে শুরু হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল থেকে। এসব প্রকল্পে অনিয়ম, অসঙ্গতি ও শুভঙ্করের ফাঁকির চিত্র উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ উপজেলার মানুষ। এসব প্রকল্প ঘিরে নানান প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহল থেকে। প্রকল্প এলাকায় তথ্য সম্বলিত সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড লাগানোর কথা থাকলেও কোথাও তা দেখা যায়নি।

সূত্রমতে, এ উপজেলার আট ইউনিয়নে ২০২৩-২৪ ইজিপিপি কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫১টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে মোট শ্রমিক সংখ্যা দুই হাজার ৬৬১ জন। মাথাপিছু দৈনিক ৪০০ টাকা মুজুরী হিসেবে দুই হাজার ৬৬১ জন শ্রমিকের ৩৩ দিনে টাকার অংক দাঁড়ায় সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। এরমধ্যে বাবুখালী ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৩৬০ শ্রমিক, বিনোদপুরে ছয়টি প্রকল্পে ৩৬৫ শ্রমিক, দীঘায় আটটি প্রকল্পে ২৫৯ শ্রমিক, রাজাপুরে চারটি প্রকল্পে ২৫১ শ্রমিক, বালিদিয়ায় আটটি প্রকল্পে ৩৫৬ শ্রমিক, মহম্মদপুর সদরে পাঁচটি প্রকল্পে ৩৭১ শ্রমিক, পলাশবাড়ীয়ায় আটটি প্রকল্পে ৩৬৯ শ্রমিক এবং নহাটা ইউনিয়নে ছয়টি প্রকল্পে ৩৮৪ শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৫১টি প্রকল্পে মোট শ্রমিক সংখ্যা দুই হাজার ৬৬১ জন। এসব প্রকল্পে অধিকাংশেই নানান অনিয়ম ও অসঙ্গতি রয়েছে। যে রাস্তায় এ প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন নেই, সেরকম রাস্তাতেও প্রকল্প নেয়া হয়েছে।

অথচ গুরুত্বপূর্ণ জরাজীর্ণ অনেক কাচা রাস্তা থাকলেও সেখানে এই প্রকল্প নেয়া হয়নি। প্রকল্পগুলোতে যে পরিমাণ শ্রমিক কাজ করার কথা তার থেকে অনেক কম শ্রমিক কাজ করছেন। কাগজে কলমে সব ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তব চিত্রে ব্যাপক গড়মিল রয়েছে। এসব প্রকল্পে শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরেজিমন তদন্ত করলে এসব প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। তারা বলেন, পিআই ও অফিসের কম্পিউটার এবং আনুষাঙ্গিক ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠালে অনিয়মটির তথ্য মিলবে।

গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫১ জন ইউপি সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যকে প্রকল্পের চেয়ারম্যান (পিআইসি বা প্রকল্পের সভাপতি) করা হয়। প্রকল্পগুলোর সার্বিক তদারকীর দায়িত্বভার স্ব স্ব ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ অফিসারদের।

গত ১৩মে সকালে মহম্মদপুর সদর ইউনিয়নের অন্তর্গত উপজেলা সদরের মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি থেকে (বাওড়ের ধার) তেলিপুকুর তোতা মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত মাটি দ্বারা রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের কাজে ৬১ জন (নারী ও পুরুষ) শ্রমিকের কাজ করার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া গেল মাত্র ২৪ জন। ৩৭ শ্রমিক ছিলেন অনুপস্থিত। এই প্রকল্পে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের গিয়ে একই চিত্র চোখে পড়লো। বেলা তিনটা পর্যন্ত কাজ করার কথা থাকলেও সোয়া একটার সময় গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। 

প্রায় প্রতিবছরই এ রাস্তাটিতে প্রকল্প নেয়া হয়। তবে স্থানীয়রা জানান, রাস্তাটিতে মাটি দেয়ার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। পুরো রাস্তায় মাটি দেয়াও হচ্ছে না। এখানে ৬৭ হাজার ৩২০ ঘনফুট মাটি দেয়ার কথা।

মহম্মদপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল আক্তার কাফুর উজ্জল বলেন, আমরা অনুপস্থিত শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করছি। তাদের বাদ দিয়ে যারা উপস্থিত থাকছে, কাজে আসছে তাদের তালিকা তৈরি করে বিলের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা দেবো।

গত ১৪মে সকালে পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের বলভদ্রপুর গ্রামের আদায় বিশ্বাসের বাড়ি থেকে শংকর মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ৭৯ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও সেখানে গিয়ে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। স্থানীয় আব্দুর রহিম জানান, কয়েকদিন ১৭-১৮ জন শ্রমিক কোদাল দিয়ে চেছে-ছুলে কয়েক জায়গায় ড্রেসিং করেছে। এই রাস্তাটির কোথাও মাটি দেয়া হয়নি। একই দিন ১২টায় ওই প্রকল্পে গিয়ে শ্রমিক শূণ্যই পাওয়া যায়। এ সড়কে ৭৮ হাজার ২১০ ঘনফুট মাটি দেয়ার কথা।

পলাশবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ সিকান্দার আলী বলেন, বর্ষাকালে মাটি দিলে কাদা হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। সে কারণে চেছে-ছুলে পরিষ্কার করা হচ্ছে। 

১৬মে সকাল ১০টা ২৮ মিনিটের সময় দীঘা ইউনিয়নের সিন্দাইন সাইফারের বাড়ি থেকে দোয়াল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার কাজ দেখতে গিয়ে সেখানে নয়জনকে ছায়ায় বসে গল্প করতে দেখা যায়। এখানে ২৫ জন শ্রমিকের কাজ করা কথা থাকলেও ১৬ জন অনুপস্থিত ছিলেন। এখানে ২৪ হাজার ৭৫০ ঘনফুট মাটি দেয়ার কথা।

একই ইউনিয়নের নাগড়িপাড়া হুমায়নের বাড়ি থেকে কুমরুল মনোয়ারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্প দেখানো হয়েছে। স্থানীয় আনিচ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তা রয়েছে। এরপর কার্পেটিং রাস্তা। এখানে ২৮ জন শ্রমিকের কাজের কথা থাকলেও কাউকেই পাওয়া যায়নি। 

স্থানীয় আব্দুল বারিক মোল্যার ছেলে হুমায়ন জানান, এই রাস্তায় বিপ্লব নামের এক ব্যক্তি মাটি দেয়। সেই রাস্তায় প্রকল্পের শ্রমিকরা কয়েকদিন এসে কোদাল দিয়ে চাছা-ছোলা করে চলে গেছে। এদিন বেলা সাড়ে ১১টার সময় সেখানে গিয়ে একজন শ্রমিককেও পাওয়া যায়নি। এখানে ২৭ হাজার ৭২০ ঘনফুট মাটি দেয়ার কথা। এ প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য আনিচ শিকদার বলেন, স্থানীয় একজন রাস্তায় মাটি দিয়েছিল, প্রকল্পের শ্রমিকরা সেই মাটি সমতল করে দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দীঘা ইউপির চেয়ারম্যান খোকন মিয়া বলেন, এটা নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে কথা বলবো।

১৮মে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের সময় বিনোদপুর ইউনিয়নের ঘল্লিয়া কবরস্থানে মাটি ভরাট প্রকল্পে গিয়ে একজন শ্রমিককেও পাওয়া যায়নি। এখানে ৫১ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। কবরস্থান ঘুরে কোথাও এক ঝুড়ি মাটি দেয়ার চিহ্ন চোখে পড়েনি। এখানে ৫০ হাজার ৪৯০ ঘনফুট মাটি দেয়ার কথা।

বিনোদপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিকদার মিজানুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে প্রকল্পের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেন। পরে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য জাহাঙ্গির আলম জানান, ঈদগাঁয় মাটি দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের তথ্যমতে ‘ঘুল্লিয়া গোরস্থানে মাটি ভরাট’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পের নাম ভুল হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মমিনুল ইসলাম বলেন, আপনি আগে চেয়ারম্যানদের বক্তব্য নেন। ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা না বলে এ বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমটির সভাপতি পলাশ মন্ডল বলেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ অফিসার ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার চলমান কর্মসূচি দেখভাল বা তদারকী করার কথা।

টিএইচ