ঘূর্ণিঝড় মোখা তার গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের উপকূল হয়ে স্থলভাগে আঘাত হানলেও শেষ রক্ষা হয়নি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। যেখানে এক নারী গাছ চাপায় আহত হলেও আর কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে পুরো দ্বীপটি ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে মোখার আঘাত।
রোববার বিকাল ৫ টার পরে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, সকাল থেকে শুরু হওয়া ঝড়ো হওয়া দুপুর ১ টার পর থেকে ক্রমাগত তীব্র হতে থাকে। বিকাল ৪ টার পর থেকে বাতাসের তীব্র কমে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই পুরো সময়ে দ্বীপের ১২ শতাধিক আধাপাকা টিন শেড ঘর, ছোট্ট মানের কটেজ বাতাসের বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ভেঙ্গে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। সাগরের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে একটু বেশি হলেও কোথাও প্লাবিত হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সদস্য (মেম্বার) খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, দ্বীপের পূর্ব পাশে অবস্থিত বাজারের অধিকাংশ দোকান বাতাসে উড়ে গেছে। গাছ চাপায় এক নারী আহত হলেও আর কেউ হতাহত হয়নি। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক সড়কের ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে চলাচল উপযোগি করার কাজ চলছে।
দুপুর ২ টায় সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের কোনারপাড়ায় গাছ চাপায় আহত দ্বীপে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিম। তিনি জানান, প্রয়োজনে তাকে টেকনাফ আনা হতে পারে।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ট্রলার মালিক সমিতি সাবেক নেতা আবু তালেব জানিয়েছেন, আগে থেকে আঘাতের যে তথ্য প্রচার হয়েছে তার মত আঘাত না হলেও দ্বীপকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দ্বীপের দক্ষিণ, পূর্ব অংশে। যেখানে ব্যাপক সংখ্যক গাছ ছাড়াও আধাপাকা, টিন শেড সকল ঘর ভেঙ্গে গেছে। উড়ে গেছে ছাউনী।
বৃষ্টির সাথে সাগরের ঢেউর তীব্রতা এখন রয়েছে বলে জানিয়েছেন, দ্বীপের ব্যবসায়ী নাহিদ হোসেন। তিনি জানান, দ্বীপের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুঁষিয়ে নিতে অনেক সময় লাগবে।
মোখার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সেন্টমার্টিন দ্বীপে হয়ে বলে স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান ও সেখান থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য মতে দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ছাড়াও ১২ শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত কোন হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দ্বীপে গিয়ে ক্ষতির সার্বিক চিত্র বা পরিমাণ জানা যাবে।
তিনি জানান, দ্বীপে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্র অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগের অনুমতি দেয়া হবে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।
উপকূল জুড়ে তাণ্ডব
কক্সবাজার জেলার উপকূল জুড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা তাণ্ডব চালিয়েছে। এই তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। তবে আঘাতের কবলে পড়েছে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়ন, উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী, পাটুয়ারটেক, সোনাপাড়া এলাকা। যেখানেও ব্যাপক সংখ্যক ঘর ও গাছ ভেঙ্গে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম জানিয়েছেন, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়নের গাছের উপর তান্ডব চালিয়েছে মোখা। এসব এলাকার ৩০ শতাংশ গাছ ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া বহু ঘর ভেঙ্গে গেছে।
এর সংখ্যা নির্ধারণে কাজ চলছে মন্তব্য করে নুরুল আলম জানান, সেন্টমার্টিন বাদ দিলে টেকনাফ উপজেলায় আরও কম হলেও এক হাজার ঘর ভেঙ্গে গেছে।
বেশকিছু গাছ ও ঘর ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সত্যতা স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, প্রাথমিক তথ্য মতে ব্যাপক সংখ্যক গাছ ভেঙ্গে গেছে। জেলায় ১২ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যার মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর ২ হাজারের বেশি। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন মিলে ক্ষতির পরিসংখ্যা নির্ধারণে কাজ শুরু হয়েছে। তবে এর সঠিক চিত্র পেতে সময় লাগবে। একই সঙ্গে জোয়ারের পানিতে নতুন করে বেড়িবাঁধের কিছু এলাকাও ভেঙ্গে গেছে বলে জানা গেছে। তা নির্ধারণেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করেছে।
কক্সবাজারস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ জানিয়েছেন, কক্সবাজারে ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩২ কিলোমিটার অরক্ষিত ছিল আগে থেকেই। এই ৩২ কিলোমিটারের বাইরে কোন অংশে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিনা দেখা হচ্ছে।
তিনি জানান, মোখা যতটুকু আঘাত আনার কথা তা হয়নি। তার কারণ আঘাত আনার সময়টি ভাটা এবং পূর্ণিমা-অমাবস্যার মধ্যে সময়কাল। তার সাথে ঢেউর বিপরীত দিকে বাতাসের দিক হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমেছে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, রবিবার বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় কক্সবাজারে ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। এরপর বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া তিন লাখ মানুষ বিকাল ৫ টা থেকে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। যদিও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, এত দ্রæত আশ্রয় কেন্দ্র না ছাড়ার জন্য বলা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও উন্নত হলে এদের ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে।
টিএইচ