কুষ্টিয়ায় মাদকের ভয়াবহ থাবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সর্বত্র। মাদকের আগ্রাসন যেন পিছু ছাড়ছে না। ফলে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে এই জেলার জনপদগুলো বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাদকের এই বিপর্যয় ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সব সংস্থা রাতদিন নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে দাবি করলেও কার্যত: মাদক নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণে কোন কাংক্ষিত সুফল আসছে না।
এক জরিপে দেখা গেছে, গত দুই বছরে (মে ২০২১ থেকে মে ২০২৩) জেলার ৬টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন দফাদার ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে।
সর্বশেষ গত ঈদের পরদিন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক শিক্ষার্থীসহ ৪ জন, গত প্রতিমা বিসর্জনের পরদিন খোকসায় ৪ ও কুমারখালীতে ৩ জন, কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজ মাঠে বন্ধুর জন্মদিন পালনে বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে ৫ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
পরিসংখ্যান সূত্রে, মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই ছিলো স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এভাবে বছরের প্রায় প্রতি মাসেই বিষাক্ত তরল বা মাদক সেবনে ২/৩ জনের তাজা প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে আরও যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে তা হলো- এ জাতীয় বিষাক্ত তরল পানে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় অধিকাংশই ময়নাতদন্ত ছাড়া নিহতদের পরিবার মরদেহ নিয়ে তড়িঘরি করে দাফন সম্পন্ন করেছে।
ফলে এসব অকালমৃত্যুর প্রায় সবগুলি ঘটনা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় কার্যত: সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যে কারণে সরকারি কোন দপ্তরেই এধরণের বিষাক্ত তরল পানে মোট মৃত্যুর সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ভুক্তভোগীদের দাবি বিষাক্ত স্পিরিট পানে মৃত্যুর বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ।
সীমান্ত সংলগ্ন জেলা হওয়ায় কুষ্টিয়াতে মাদক কারবারিদের বাড়তি সুযোগ থাকায় এই রুটকে আদর্শ রুট হিসেবে ব্যবহার করে। এসব রুটের মাদক চোরাচালান ঠেকাতে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে তৎপর আছে সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
এরমধ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণই অধিদপ্তর কুষ্টিয়া, র্যাব ও ৪৭ বিজিবি কুষ্টিয়ার গত একবছরে মাদক উদ্ধার ও গৃহীত আইনগত পদক্ষেপের পরিসংখ্যান চিত্রে দেখা যায়, মোট মামলা সংখ্যা ১২৬০টি এবং এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৪৪০ আসামি। এর মধ্যে- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামলা সংখ্যা ১৫৯, গ্রেপ্তার ১৭৮, র্যাব-১২, সিপিসি-১ কুষ্টিয়া ক্যাম্প মামলা-৯৭টি গ্রেপ্তার ২শতাধিক, ৪৭ বিজিবি কুষ্টিয়া-মামলা ১০০৪টি গ্রেপ্তার ৫৫, যদিও মাদক উদ্ধারে সর্বোচ্চ অবস্থানে বিজিবি এবং মামলা ও গ্রেপ্তার উভয় মিলে তুলনামূলক অন্যদের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে র্যাব-১২।
তবে প্রায় মাসাধিককাল চেষ্টা করেও মাদক সংক্রান্ত কোন তথ্য কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের কাছ থেকে না পাওয়ায় উল্লেখিত পরিসংখ্যানে পুলিশের ভূমিকা সংযোজন করা যায়নি এই প্রতিবেদনে।
জেলা কারা তত্ত্বাবধায়কের দেয়া তথ্যমতে, এখানে মোট ৬শ বন্দির মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশই মাদক মামলার আসামি হিসেবে বন্দি আছে।
গত ২১ মে কুষ্টিয়া জেলা আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক মাসিক সভায় কুষ্টিয়াতে মাদক আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে মতামত ব্যক্ত করেন সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বশীল নেতারা। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য হাজি গোলাম মহসিন বলেন, কুষ্টিয়াকে মাদকমুক্ত করতে নিরলস দায়িত্ব পালন করছেন বলে যারা দাবি করেন, আমার মতে তাদের কাজের সক্ষমতার চেয়ে প্রচারের সক্ষমতা বহুগুণ বেশি।
৪৭ বিজিবি কুষ্টিয়ার উপ-অধিনায়ক মেজর রকিবুল ইসলাম বলেন, বিজিবি বিভিন্ন সময় বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও জব্দ করতে সক্ষম হলেও জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাংক্ষিত সক্ষমতা দেখাতে না পারার অন্যতম কারণ হলো-সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় চোরাকারবারিরা পরিস্থিতি বেগতিক দেখলেই মালামাল ফেলে সীমান্ত পার হয়ে ভারত ভু-খন্ড ঢুকে যায়।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, জেলা জুড়ে মাদকের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে গুরুত্বসহকারে আলোচনায় উঠে এসেছে জেলা আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক মাসিক সভায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তাগণকে আরও তৎপর হওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
টিএইচ