ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে গণহত্যায় অংশ নিতে নিজাম হাজারীর নির্দেশে স্থানীয় পৌর ৪নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি লিটনসহ ৮ জনের হাতে শর্টগান তুলে দেন পৌর যুবলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম ভূঞা ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বাবলু।
এছাড়া সেদিনের হামলায় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আ.লীগ নেতাকর্মী গুলি চালিয়েছে। গত ৩ অক্টোবর এ গণহত্যায় শহীদ সিহাব হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি লিটন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনার বর্ণনায় এ কথা বলেন।
এর আগে গত ২ আগস্ট র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন লিটন। ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েদ মো. শাফায়াত দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা তার এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা যায়, লিটন আদালতকে জানিয়েছে- ৪ আগস্ট সেসহ ৮ জন যুবলীগ নেতা-কর্মী পৌরসভায় আসে। সেখানে আরও ৩শ থেকে ৪শ দলীয় নেতাকর্মী ছিল।
এসময় ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী সবার উদ্দেশ্যে রাখা বক্তব্যে যেকোনো মূল্যে ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। তখন তার পাশে ছিলেন সদর উপজেলা আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল ও পৌর সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী।
এরপর মাস্টারপাড়া থেকে সাদা প্রাইভেটকারের মাধ্যমে ব্যাডমিন্টন ব্যাগে করে কয়েকটি শটগান আনা হয়। পৌরসভার লিবার্টি সুপার মার্কেটের নিচতলায় কৃষকলীগের অফিস কক্ষে লিটনসহ ৮ জনকে ডেকে নিয়ে ৮টি শটগান ও ১০ রাউন্ড করে গুলি দেয় রফিক ও বাবলু। এ সময় যারা অস্ত্র চালাতে জানতো না তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়।
ওই সূত্র আরও জানায়, মহিপালে হামলার সময় জেলা আ.লীগ সদস্য ও ফাজিলপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মজিবুল হক রিপন, ফুলগাজী উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন মজুমদারকে অনুসরণ করতে অস্ত্রধারীদের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর ৪০-৫০ জন নেতাকর্মী বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ১শ থেকে ২শ জন দেশি অস্ত্র নিয়ে মহিপালের দিকে যায়। এদের মধ্য থেকে অস্ত্রধারী ও অস্ত্র ছিল না এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নাম আদালতে জানায় লিটন।
মহিপালে ছাত্র-জনতার উপর গুলি করার সময় নিজে চৌধুরীবাড়ির মুখে অবস্থান নিয়ে ওপরের দিকে ৮ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলে জানান লিটন। পরবর্তীতে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কৃষকলীগের অফিসে গিয়ে রফিক-বাবলুর কাছে নিজের অস্ত্র জমা দেন দাবি করে বলেন, এসময় ব্যবহার না হওয়া ২ রাউন্ড গুলিও ফেরত দিয়েছেন সে।
সিহাব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. মোতাহের হোসেন তদন্তের স্বার্থে তিনি অপর জড়িত কারও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তবে, জবানবন্দিতে লিটনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তদন্ত কাজ চলছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও এ গণহত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মুরাদ হোসেন বাবু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
৪ আগস্ট মহিপালে গণহত্যায় কলেজছাত্র মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় গত ৪ অক্টোবর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এ সংক্রান্তে দায়ের কারা মামলায় গ্রেপ্তার মুরাদ হোসেন বাবু। এসময় গণহত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় সে। জেলার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহানা লোকমান তার এ জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
এর আগে গত ৩ অক্টোবর জেলার সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের মিয়ার বাজার এলাকা থেকে বাবুকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৭। বাবু ওই ইউনিয়ন যুবলীগের অর্থ সম্পাদক ও স্থানীয় রসুল আমিনের ছেলে। মাহবুবুল হাসান আন্দোলনরত মাসুম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হওয়ার পর থেকে পলাতক ছিল।
জেলার মহিপালের এ গণহত্যার ঘটনায় করা একাধিক মামলার আইনজীবী মেজবা উদ্দিন ভূইয়া বলেন, গত ৪ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত গণহত্যার ঘটনা সবার জানা। তবুও ছাত্রলীগ নেতা লিটন ও বাবুর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিচারে সুফল বয়ে আনবে। এছাড়া বিবেকের তাড়নায় নারকীয় এ গণহত্যাকাণ্ডের চিত্র অনেক আসামি নিজেদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তুলে ধরবে।
অন্যদিকে এ গণহত্যাসহ হত্যার চেষ্টায় মোট ১৬ টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৮টি হত্যা ও ৮টি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ১টি মামলায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খানসহ প্রতিটি মামলায় ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী আসামি হয়েছেন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আ.লীগের প্রায় ৪৫০০ নেতাকর্মীও আসামি রয়েছেন।
এদিকে গত বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার তিন দিনে এসব মামলার এজাহার নামীয় ও সন্ধিগ্ধ ৪৫ জন আসামিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
ফেনী মডেল থানার ওসি মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, গ্রেপ্তারদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যহত রয়েছে।
টিএইচ