শ্রীপুরের ৫৫ বছর বয়সী বেলায়েতের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তার রোল নং ছিল ২২৩১৩১-০০০৫। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণের মাধ্যমে বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তির দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হলো তার। এর আগে তিনি ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ৫৫ বছর বয়সী সেই বেলায়েত শেখ।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম, কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান শাতিল সিরাজ বেলায়েত শেখের উর্ত্তীর্ণের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, অনুষ্ঠিত ৬০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার মধ্যে তিনি ৩২ নম্বর এবং অন্যান্য একাডেমিক ক্যারিয়ারের জন্য পেয়েছেন ৩৬ নম্বর। সবমিলে ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৬৮ নম্বর পেয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বেলায়েত।
বেলায়েত শেখ জানান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তিনি প্রচুর লেখাপড়া ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজম, কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও লেখাপড়ার ইচ্ছা পূরণ হলো। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেয়া বেলায়েত,
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখন্ড এলাকার মৃত হাসেন আলী শেখ ও জয়গন বিবির চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় বেলায়েত শেখ। ছোট থেকেই তার পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রচুর আগ্রহ ছিল। আগ্রহ থাকলেও পরিবারের দরিদ্রতার কারণে তখন তা হয়ে উঠেনি। এত বিপত্তির মাঝে ১৯৮৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) যেই না মাত্র বসতে যাবে তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা হাসেন আলী শেখ। পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপের পুরো টাকা ব্যয় হয় বাবার চিকিৎসার পেছনে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে বন্যা আর ১৯৯১-৯২ সালে মায়ের অসুস্থতার আর লেখা পড়া করা হয়নি। মা ভক্ত বেলায়েত মনে করেন, দুনিয়াতে মা বেঁচে না থাকলে এই লেখাপড়া দিয়ে কি হবে। লেগে পড়েন মাতৃসেবায়। কাঁধে নেন পুরো সংসারের দায়িত্ব। এসএসসি দিতে না পারায় মেকানিক্যাল কোর্স করে মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপ কাজ শুরু করেন। তা দিয়েই চলে সংসার। সঙ্গে ভাই-বোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে।
মুঠোফোনে কাঁদতে কাঁদতে বেলায়েত শেখ বলেন, আমার মায়ের পরে আমি আমার মেয়েকে অনেক ভালবাসতাম। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মেয়েটি হয়তো আমার মুখ উজ্জ্বল করবে। হবে বিসিএস ক্যাডার। সেজন্য রাজধানীর নামকরা কলেজে ভর্তিও করিয়েছিলেন। কিন্তু, মেয়ে সেখানে পড়াশোনা না করেই শ্রীপুরে চলে আসে। সেখানে এইচএসসি শেষে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। সকল স্বপ্ন যেন তখনই শেষ হয়ে যায়, বেলায়েত শেখ বলেন। ওই কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়েছে তার মেয়ে। এরপর তাকেও বিয়ে দিয়ে দেন। এদিকে বেলায়েত শেখের সবচেয়ে ছোট ছেলে বিগত মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছেন, তিনিও পড়ছেন একটি ইঞ্জিনিয়ারিংএ কলেজে।
চলতি বছরে ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি-ভোকেশনাল) জিপিএ ৪.৪৩ নিয়ে পাস করেন। এর আগে ২০১৯ সালে রাজধানীর বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসা থেকে জিপিএ ৪.৫৮ পেয়ে মাধ্যমিক সমমান দাখিল (ভোকেশনাল) পাস করেন। সবকিছু পেছনে ফেলে আবার পড়াশোনা করে করে পঞ্চাশোর্ধ বেলায়েত তার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে বেলায়েত শেখ বলেন, আজকের ছেলে মেয়েরা অনলাইনে যে সময় ব্যয় করে, তারা যদি লেখাপড়ার পেছনে এ সময় দেয়। বাবা-মার সেবা যত্ন করে, তারা অনেক সফল হবেন। বাবাকে একটু মাকে একটু খুশি করি, কেন যেন সন্তানেরা এটা বোঝে না।
রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগের প্রতিক্রিয়ায় বেলায়েত শেখ বলেন, আমার পড়াশোনার অনুপ্রেরণা প্রথমে আমার মা। তিনিউ আমার সকল অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এছাড়া শ্রীপুর কারিগরী কলেজের প্রভাষক বন্ধুবর সিদ্দিক ও ওনার স্ত্রী মারুফা এবং অধ্যক্ষ সেলিমের ভাইয়ের কারণে এতদূর আসতে পেরেছেন। পাশাপশি সারাদেশের আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা এ বয়সে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্য ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন করায় সকলের দোয়া ও ভালবাসা আমার স্বপ্ন ও আশা পূরণে উত্তীর্ণ হওয়ায় সহযোগীতা হয়েছে। বেলায়েত একটি জাতীয় দৈনিকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।
কেএস