দেশের সীমান্তঘেষা সর্ব উত্তরের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দুই-সীমান্তের বুক চিরে প্রবাহিত মহানন্দা নদী। এ নদীতে জীবিকার তাগিদে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডুবে ডুবে নুড়ি পাথর তুলছে হাজার হাজার শ্রমিক। দিনভর পাথর তুলে সন্ধ্যায় মহাজনের কাছে বিক্রি করে মৌলিক চাহিদা মিটে পরিবার-পরিজনদের।
তেঁতুলিয়ার প্রায় ২ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে মহানন্দা নদীতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পাথর শ্রমের সঙ্গে জড়িত। মহানন্দা যেন হাজার হাজার মানুষের জীবিকার বিশাল ভান্ডার। প্রতিদিন লাখ লাখ সিএফটি নুড়ি পাথর উঠে এই নদী থেকে।
অনেকে ফজরের নামাজ পড়ে শ্রমিকরা দল বেঁধে হাওয়ায় ফুলানো গাড়ির টিউব, লোহার জাকলা, চালুনি ও লোহার রড নিয়ে নেমে পড়ছে নদীতে। দিনভর চলে পাথর তোলার প্রতিযোগিতা। তারপর নদীর কিনারে এনে স্তুুপ করা হয় ওই পাথর। দিনশেষে মহাজনের কাছে বিক্রি করে মজুরি হিসেবে মিলে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
বুধবার (২৪ জুলাই) জাফর ইসলাম, ফরিদুল ইসলাম ও বাবুল আকতার জানান, কয়েকদিন যাবৎ নদীতে পানি বেশি থাকায় পাথর উঠাতে পারছেন না। তাই খুব কষ্টে আছেন। বাইরে কাজও নেই বলে জানান তারা। পাথর শ্রমিক আনারুল বলেন, এই মহানন্দা নদীডাই হামাগ বাঁচাই রাখছে। হামার একটা ব্যাটা এক বেটি। বেটিডাক বিহাই দিছু। এ পাথর তুলে সবকিছু চলেছে।
অপর পাথর শ্রমিক সফিকুল ইসলাম জানান, ঘরে স্ত্রীসহ চার ছেলেমেয়ে। সন্তানের ভরণ-পোষণ চলে এই পাথর জীবিকার ওপর। দিনভর দলের সঙ্গে পাথর তুলে সন্ধ্যায় পারিশ্রমিক নিয়ে পরিবারের অন্ন-বস্ত্র শিক্ষাসহ যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা চলে বলে জানান তিনি।
তারা আরও জানান, অনেক সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যায় পাথর তোলার কাজ। কয়েকদিন ধরে নদীতে পানি বেশি, তাই নদীতে পাথর তুলতে নামতে পারছেন না। এতে কমেছে রুজি-রোজগার।
জানা যায়, মহানন্দার পাথর ঘিরে শত শত নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। তারা নদীর তীরে পাথর নেটিং, শোটিং ও ক্রাশিংয়ের কাজ করছে। খুব ভোরে ঘরের গৃহস্থালি কাজ সেরে ঘর থেকে ওই নারীরা বের হন কাজের উদ্দেশে। পেটের কাছে ঝড়-বৃষ্টি গরম ঠান্ডার হার মানে এসব কর্মজীবী মানুষদের কাছে। অটোভ্যান, অটোরিকশা ও কেউ সাইকেল চালিয়ে যোগ দেয় কাজে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা পানির মধ্যে জীবিকার সন্ধান চলে।
ক্যাশিং মেশিনে পাথর ভাঙা কাজে নিয়োজিত সখিনা খাতুন জানান, ফজরের আজান শুনে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজের ও দুই সন্তানের জন্য রান্না করতে হয়। সন্তানদের কোনো দিন খাইয়ে কোনো দিন না খাইয়ে বেরিয়ে পরতে হয় তাকে। দেরি করে কাজে পৌঁছালে মহাজনের বকাঝকা শুনতে হয়। কোনো কোনো দিন দেরি করার কারণে কাজেই নেয়া হয় না। এরকম গল্প আমেনা, রহিমা, জরিনার মতো শত শত নারী শ্রমিকের।
উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন খান জানান, তেঁতুলিয়ার সিংহভাগ মানুষ পাথর শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হাজার হাজার শ্রমিক মহানন্দা নদীতে পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করছে। তারা সবসময় চেষ্টা করেন, যাতে শ্রমিকরা ভালো থাকে, নদীতে পাথর তুলে সচ্ছলভাবে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।
টিএইচ