যশোরের পরিবেশ অধিদপ্তর জেলার উপর দিয়ে প্রবহমান ১৯টি নদীর পানি নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেছে। পানি দূষণ ও মাছসহ জলজ প্রাণি ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা নিরূপণ করতে ৯টি প্যারোমিটার পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, বিওডি, সিওডি, হার্ডনেস, কনডাকটিভিটি, লবণাক্ততা, টোটাল ফসফেটসহ অন্য প্যারামিটার ভাল আছে কিনা তা নিয়ে কাজ শুরু করছে যশোর পরিবেশ অধিদপ্তর। এরমধ্যে জেলার ৮টি নদীর উপর গবেষণা শেষ হয়েছে। ৪টি নদীর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ পাওয়া গেছে। আর ৮টির বাইয়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বিওডি এবং ডিজলভ অক্সিজেন ডিও নির্দিষ্ট মানমাত্রা বাইরে রয়েছে।
এসবের কারণে নদীর পাড় ঘেঁষা হাসপাতাল, ক্লিনিক, শিল্প কারখানা, আবাসিক এলাকার ড্রেন থেকে বর্জ্য ফেলা দূষণের অন্যতম বলে দাবি পরিবেশ অধিদপ্তরের। ভারি ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা যাতে দূষণ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে না পৌঁছে এবং এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষে কঠোর অ্যাকশনে যাওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপ পরিচালক এমদাদুল হক।
বিভিন্নভাবে গবেষণা থেকে তথ্য মিলেছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ভারি ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিপূরণের জন্য অবিলম্বে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ১০টি ভারি ধাতুর (এএস, পিবি, সিডি, সিআর, এফই, এমএন, সিইউ, সিইউ, সিও, এনআই, জেডএন) দূষণের প্রবণতা পরীক্ষা করে ইতোমধ্যে দেশের জলপথের ভয়াবহ চিত্রও উঠে এসেছে। আর্সেনিক (এএস), সীসা (পিবি), ক্যাডমিয়াম (সিডি), ক্রোমিয়াম (সিআর), লোহা (এফই) ও ম্যাঙ্গানিজের (এমএন) গড় ঘনত্ব তিনটি ঋতুতেই গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর গ্রীষ্মের মাসগুলোতে সর্বাধিক দূষণ হয়।
আর এসবের উপর গুরুত্ব দিয়ে যশোর পরিবেশ অধিদপ্তর মাঠে নেমেছে। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর দুই মাস কাজ করেছে নদীর উপর। সাধারণত যশোরের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে নদী ব্যবহার করেন, আবার তীরবর্তী সামগ্রিক জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকাও নির্ভর করে। নদীর পরিবেশ সুস্থ থাকলে সে নদীতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার, খাবার পানি সংগ্রহ, গোসল, যোগাযোগ, কৃষি, মৎস্য আহরণ করেন।
কিন্তু নদীতে মাছের বেঁচে থাকা ও অন্যসব জলজপ্রাণির জন্য পরিবেশগত স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি আদৌ ঠিক আছে কিনা তার জন্য জেলার ১৯টি নদীর পানির উপর গবেষণা চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে গবেষণা করা হয়েছে ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, কপোতাক্ষ, আপার ভদ্রা, বুড়ি ভদ্রা, হরিহর, হরিহর মণিরামপুর অংশ, ভৈরব দড়াটানা অংশ, ভৈরব ঢাকা ব্রিজ অংশ, ভৈরব নওয়াপাড়া অংশের পানি। সুস্থ নদীর জন্য ডিজলভ অক্সিজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৫ এর উপরে থাকা জরুরি। কিন্তু এদের মধ্যে বেতনায় পাওয়া গেছে ৪.১১, কপোতাক্ষে পাওয়া গেছে ৪.২৮, মুক্তেশ্বরীতে পাওয়া গেছে ৪,২৭। আর সহনীয় পর্যায়ে পাওয়া গেছে ভৈরব নওয়াপাড়া অংশের পানি।
ভৈরব দড়াটানা ও ঢাকা ব্রিজ অংশে পানি দূষণ পাওয়া গেছে অসহনীয় মাত্রায়। তবে পারোমিটার ঠিক থাকলেও সবগুলোই বাইয়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বিওডি এবং ডিজলভ অক্সিজেন ডিও নির্দিষ্ট মানমাত্রার বাইরে পাওয়া গেছে।
এছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে একে একে গবেষণা করা হবে নবগঙ্গা, চিত্রা, ইছামতি কালিন্দি, আফ্রা, হাপর খালীর, শ্রী যশোর, হরি, টেকা, হাকর, আতাই, কোদালিয়া, আমড়াখালি, দায়তলা নদীর পানি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রের দাবি, হাসপাতাল, পলিথিন, ট্যানারি, টেক্সটাইল ও ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানা, সার কারখানাসহ শিল্প কারখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যশোরের নদীগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সৃষ্ট ভারি ধাতুসম্পন্ন অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। যে কারণে পরিবেশগত মারাত্মক সংকট তৈরি হচ্ছে। যা বছরের পর বছর ধরে খারাপ হয়ে চলেছে। যা জলজ জীববৈচিত্র, মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপ পরিচালক এমদাদুল হক জানান, বিষাক্ত ভারি ধাতু জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তা যশোরের অনেক নদীতে ফেলা হচ্ছে হরহামেশাই।
এসব দূষণ রোধে পরিবেশ ও নদীর পানি দূষণকারীদের সতর্ক করতে অ্যাকশান নেয় হয়েছে। যশোরের ভৈরবপাড়ে গড়ে ওঠা প্রাইভেট হাসপাতাল ও কয়েকটি কারখানা থেকে বর্জ্য ছড়ানো হচ্ছে নদীতে। আবার পলিথিন ফেলা হচ্ছে অদূরদর্শীভাবে। গত দুই মাসে ৮টি নদীর উপর গবেষণা করা হয়েছে, আর বাকি নদীগুলোতে অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চলমান রাখা হবে। দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন।
টিএইচ