‘প্রত্যেক বছর বানের (বন্যায়) পানিত হামরা ডুবি মরি, ঘরবাড়ি ভাঙি যায়। নদীত পানি থাকলে নৌকা আর শুকি গেইলে (শুকনো মৌসুমে) হাঁটি পার হওয়া ছাড়া উপায় নাই। সরকারোক কন হামার এত্তি কোনা একটা ব্রিজ খুব দরকার।’
কথাগুলো বলছিলেন কৃষক ফয়জুর রহমান। তিনি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব গ্রামের বাসিন্দা। নদীর কোল ঘেঁষে থাকা ফয়জুর রহমান তিস্তার বুকে একটি সেতু নির্মাণের দাবি প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন।
শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীর প্রায় পুরোটাজুড়ে চর জেগে ওঠে। এ সময় তিস্তা নদী সরু হয়ে আসে। বালুচর মারিয়ে এসে নৌকায় চড়ে তখন দু’পাড়ের মানুষ আসা-যাওয়া করেন। বর্ষায় চার কিলোমিটার প্রশস্ত তিস্তা নদী টইটম্বুর হয়ে ওঠে। ওই সময়টায় কিছু অংশ পায়ে হেঁটে, কিছু অংশ নৌকায় পারাপারে আর সুযোগ থাকে না। তখন একমাত্র নৌকাযোগে পার হতে হয়।
জানা যায়, ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া, শিবদেব, বোল্ডারের মাথা, মধ্যপাড়া, পাকারমাথা, বালাপাড়া, হাগুড়িয়া হাশিম, থেরাই ইউনিয়নের থেরাই, গোড়াইবিয়ার চর, ইন্দুরমারা চর, কুমারপাড়াসহ দু’পাড়ের ৩০টি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন তিস্তা নদী পারাপার হয়ে থাকে। শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীর বুকে একাধিক চর জেগে ওঠে। উজানের স্রোতের সঙ্গে আসা পলিতে উর্বর হয় চরের মাটি। এসব চরে ধান, আলু, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা ফসল জন্মায় কৃষক।
শিবদেব বোল্ডারের মাথা গ্রামের বাসিন্দা শরিফা বেগম। বাড়ির উঠানে বসে নষ্ট বাদাম থেকে কিছু ভালো বাদাম আলাদা করার কাজে ব্যস্ত তিনি। গত বছর বন্যায় তার প্রায় ১৩২ শতক জমিতে চাষ করা বাদামের অর্ধেকই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। যেটুকু বাদাম নদী থেকে তুলে আনা সম্ভব হয়েছে তার অবস্থাও বেশি ভালো না।
অন্যদিকে থেরাইয়ের চরে ভালো কোনো স্কুল-কলেজ না থাকায় সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা ছাওলা ইউনিয়নে লেখাপড়া করতে আসে। বর্ষায় জীবনঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে এবং শুকনো মৌসুমে নৌকা ও পায়ে হেঁটে প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে হয়। যাতায়াতের এই বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে বহু শিক্ষার্থী সঠিক সময়ে বিদ্যাপীঠে পৌঁছতে পারে না। স্কুল ও কলেজের পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে আসা নিয়ে কত যে টেনশন, অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের পোহাতে হয়, তা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ছাড়া কেউ জানে না। সেই সঙ্গে অধিবাসীদের হাটবাজার, চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
অপরদিকে ছাওলার অধিবাসীদের বেশিরভাগই নদীভাঙনে পড়েছেন। তাদের আবাদি জমি তিস্তাগর্ভে চলে গেছে। তাই চরে ফলানো ফসলই তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। এই অবস্থা থেকে একটু হলেও উন্নত জীবনের আশায় এলাকাবাসী থেরাইয়ের চর থেকে বোল্ডারের পাড় পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছেন।
জনপ্রতিনিধিরা প্রতিবছরই সেতু বানিয়ে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে এসেছে। কিন্তু তা শুধু আশ্বাসই থেকে গেছে। ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেব এলাকার শিক্ষার্থী রুহুল, বিলকিস, সুমন ও আমেনা বলেন, ছাওলা থেকে থেরাইয়ের চরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার। বর্ষার সময় ভারত পানি ছেড়ে দিলে আমাদের এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। সে সময়ে থেরাইয়ের চরের মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে পীরগাছায় আসতে পারে না। শুষ্ক মৌসুমে চরের ফসল আনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। একটি সেতু থাকলে কষ্টের মুখ দেখতে হতো না। সহজে ফসল চর থেকে আনা যেত। যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো।
বোল্ডারেরপাড় এলাকার আশরাফুল ইসলাম বলেন, সেতু নির্মাণের সঙ্গে নদীশাসন করা হলে কুড়িগ্রাম ও রংপুরের মানুষের জীবন বেঁচে যায়। প্রতিবছরই ভাঙন তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এখন তিস্তা নদী মানুষ হেঁটে পার হচ্ছে, কষ্ট করে চাষাবাদ করছে। একাধিকবার তিস্তা নদী ঘিরে নানা মহাপরিকল্পনার কথা শুনেছি। কিন্তু কিছুই তো হলো না। হলো না নদীশাসন। সর্বাগ্রে যা দরকার ছিল। একটি সেতু নির্মাণও এই বৃহৎ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে সহায়ক হতো। তাও করা হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে কি না জানি না।
ছাওলা ইউপি চেয়ারম্যান নাজির হোসেন বলেন, তিস্তা নদীর এই পয়েন্টে সেতু না থাকায় এলাকার অনেক কষ্ট। সেতুর দাবি বহুদিনের। কিন্তু সরকার এই দাবির কথা কানে তোলেনি। নির্বাচনের সময় সবাই প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু কেউ আর তা বাস্তবায়ন করে না। এবার আমরা স্বপ্ন পূরণের আশায় বুক বেঁধে আছি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিসুল ওহাব খান বলেন, দুই ইউনিয়নবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক্কলন তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া স্যার নিজেই নদী এলাকা পরিদর্শন করে সেতু নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করছি, সামনে ভালো কিছু হবে।
টিএইচ