স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পর আবারো ফিরে এলো সেই ভয়াল ১৩ সেপ্টম্বর। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের কাঁদাতে ও ১৯৭১ এর ১৩ সেপ্টেম্বরের সেই বিভৎস রূপ স্মরণ করে দিতে।
১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি সস্ত্র দল জেলার সাপাহারবাসীকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং সে যুদ্ধে ২১ জন বীর সেনা হাসিমুখে তাদের তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অনেকেই। তাই ১৩ সেপ্টেম্বর সাপাহারবাসীর জন্য ইতিহাসে ভয়াল দিন হিসেবে আজও পরিচিত। প্রতিবছর এই দিনটি স্মরণ করে অনেক সন্তান হারা মা, ভাই হারা বোন ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা অঝোর ধারায় তাদের চোখের পানি ফেলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে দিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম জাহিদুল ইসলাম, মনছুর আলী, আ. রাজ্জাকসহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকার কিছু প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে থেকে অনুসন্ধান করে জানা যায়, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সাপাহার সদরের পূর্বদিকে একটি পুকুর পাড় ও পাড় সংলগ্ন স্কুলে (বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
এখান থেকেই তারা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অসহায় মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি নিরহী লোকদের ব্রাশফায়ার ও বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে থাকত। দেশের এই প্রতিকূল অবস্থায় বর্বর হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সাপাহারবাসীকে মুক্ত করার জন্য সাপাহার ও মহাদেবপুর এলাকার ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকহানাদার বাহিনীর লে. শওকত আলীর অধীন সাপাহারের ওই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে উৎখাত করার জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ চালানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
অবশেষে শেষ রাতের দিকে ধানক্ষেতে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার সাথে সাথে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুুল লড়াই। লড়ায়ের একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার দলটি যখন শত্রু সেনাদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক এমনি অবস্থায় ভোরের আভাস পেয়ে ব্রিজে মাইন বসানোর দলটি সেখান থেকে সরে পড়লে তার কিছুক্ষণ পরই পত্নীতলা হতে অসংখ্য শত্রু সেনা আরও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে।
এর পর শত্রুপক্ষের অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মুখে হিমশিম খেয়ে একসময় বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এ সময় শত্রুপক্ষের গুলির আঘাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদসহ ১৫ জন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করেন। আহত হন মনছুর আলী, এসএম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহমদ উল্লাহ, সোহরাব আলী, নুরুল ইসলামসহ অনেকে। এ ছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন আটজন মুক্তিযোদ্ধা।
শত্রুরা আটক আটজনের মধ্যে চারজনকে পত্নীতলার মধইল স্কুলের ছাদে তুলে কুপিয়ে হত্যা করে লাশগুলো লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। দুইজনকে ধরে এনে মহাদেবপুরের একটি কূপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয় এবং সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের ও মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর গ্রামের মৃত এসএম আবেদ আলীর পুত্র টকবগে যুবক এসএম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোরের রাজবাড়ীতে তৈরিকৃত জেলখানায় বন্দি করে রাখে।
শত্রু সেনার বন্দিদশা ও সেই ভয়াল ১৩ সেপ্টেম্বরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জেল ফেরত যুদ্ধাহত জাহিদুল ইসলাম হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন আস্তানা গোপন তথ্য ও অস্ত্র ভাণ্ডারের খবর জানার জন্য প্রতিদিন সকালে তাদের দু’জনকে হানাদার বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে উপস্থিত করা হতো।
তথ্য আদায়ে ব্যর্থ হলে কর্মকর্তার সামনেই ধারালো অস্ত্র (চাকু) দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে লবণ মাখিয়ে দেয়া হতো। অসহ্য যন্ত্রণায় অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন ছটফট করতো শত্রুবাহিনীর সকলেই তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। এমনি হাজারো দুঃখ কষ্টের মাঝে থেকে সুযোগ বুঝে একদিন তারা জেলের প্রাচীর টপকে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচেন।
টিএইচ