শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
The Daily Post

১৭ বিয়ে করে ১০৬ বছর বয়সী কোরবান আলী এখন বৃদ্ধাশ্রমে

বগুড়া প্রতিনিধি

১৭ বিয়ে করে ১০৬ বছর বয়সী কোরবান আলী এখন বৃদ্ধাশ্রমে

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার রাজবাড়ি গ্রামে জন্ম ১০৬ বছর বয়সী কোরবান আলীর। কাজের সূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন বিভিন্ন জেলায়। গল্পের শুরু ঠিক এখানেই। বগুড়া, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিয়ে করেছেন মোট ১৭টি।

১৫ মেয়ে আর ১১ ছেলে মিলে মোট ৩৫ সন্তানের বাবা কোরবান আলী আজ বৃদ্ধাশ্রমে। গত ৬ মাস হলো আছেন বগুড়া শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ, জোয়ানপুরে অবস্থিত সোনাভান বয়স্ক পূণর্বাসন কেন্দ্রে। ভালোবাসা দিবসে সেচ্ছাসেবী সংগঠন অঙ্কুরের আয়োজনে সেখানে গিয়েছিলাম একবেলা একসাথে খাবার খাওয়া, কেক কাটা ও ফুল দিতে। সেখানেই পরিচয় গৃহহীন কোরবান আলীর সাথে।  

বললাম, ”দাদু আপনার বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না?” রাজ্যেরে আক্ষেপ নিয়ে কাপা কণ্ঠে বলেন, মনে কয় বাড়িত যামু। কইয়া কি করমু? বাড়িত যাইয়া তো কোনো শান্তি নাই। মনেত আঘাত লাগে। কেউ তো নাই হামার।” হঠাৎ খেয়াল করলাম চোখের পানি কুচকানো গাল বেয়ে টপ টপ করে মাটিতে পরছে। অনেকক্ষণ নীবর থাকলেন। এরপর দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, হামার মাথাত একন তেল নাই, তেল থাকলে সবই থাকলোনি। 

১৭ জন বউয়ের ৩ জন মারা গেছে, ৫ জন বেঁচে আছে। বাকিদের খোঁজ নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের নিজেই বাড়ি-ঘর বানিয়ে দিয়েছেন কোরবান আলী। জমি ছিলো ১৩ বিঘা। মাঝে একবার অসুস্থ হয়ে সাড়ে ১১ বছর বিছানায় পরেছিলেন। তখন সব জমি বিক্রি করে চালিয়েছেন নিজের চিকিৎসার খরচ। শরীরে বাসা বেধেছে এজমা।

হাত পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা। সারা শরীরেই যেন বাসা বেধেছে বৃদ্ধকালের রোগগুলো। প্রতিদিন ৪-৫শ টাকার ওষুধ লাগে। সবটায় পান বৃদ্ধাশ্রম থেকে। ৩৫ সন্তানের মধ্যে বেঁচে আছে এক ছেলে আর দুই মেয়ে। ছেলে আব্দুল মোতাহার শেখ রিকশা চালায়। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। নাতী-নাতনীও আছে।

মেয়ের জামাই তাকে নিতে চাইলেও মেয়ের অতি-অভাবের সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে চান নি কখনোই। তাই জীবনে শেষ অধ্যায়ে দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচতে একাই এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। 

বৃদ্ধাশ্রমের অন্যদের আত্মীয়-স্বজন এলে তারা ছুটি পান। বাড়িতে গিয়ে থেকে আসতে পারেন কিছুদিন। কোরবান আলীর সেই সৌভাগ্যটুকুও মেলে না। ঈদের সময় বাসায় যেতে চান কিনা এমন প্রশ্নে কোরবান আলী আক্ষেপ করে বলেন, একন তো এটিই থাকা লাগবি। বাড়িত বেশি যাই না, মনে দুক্ক লাগে।" পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।

তবুও অদৃশ্য আত্মার বন্ধন আর মায়া এখনো চোখে মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠে। তাই নাতিকে মাদরাসায় ভর্তি করাতে চান। পয়সা কড়ির আভাবে সেটাও হচ্ছে না। পোশাকসহ হাজার দুই-এক টাকা লাগবে। হয়তো ঠিকই জানেন বৃদ্ধাশ্রমে বসে এই টাকা জোগাড় করতে পারবেন না তিনি। তবুও চিন্তা করেন বৃদ্ধাশ্রমের উঠানে বসে বসে।

ধর্মভীরু কোরবান আলী এখনো দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন। বার বার বুঝানোর পরও নামাজ-কালাম না পড়ায় কয়েকজন বউকে ছেড়েও দিয়েছিলেন। বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে ছোট্ট একটি নামাজের জায়গা আছে। সেখানে তিনি প্রতি ওয়াক্ত আযান দেন।  

আমি যখন বৃদ্ধাশ্রমের উঠানে বসে উনার জীবন গল্প শুনছিলাম, তখন পাশেই চেয়ারে বসে ছিলেন সেখানকার মহিলা বৃদ্ধারা। যারা জীবন যুদ্ধে হেরে গেছেন। 

পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না। বুকে শত কষ্ট পাথর বেধে কোরবান আলীর মতো হাজারো বৃদ্ধ দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাচ্ছেন। মৃত্যুর দিন গুণছেন। আমি খেয়াল করেছি আমাদের কাছে পেয়ে তারা যেন পরিবার ফিরে পাবার আনন্দ উপভোগ করেছে। বার বার বলছিলেন, ”আমার সাথে একটা ছবি তোলো বাবা।” ছবি তোলার পর আবার বলছিলেন, “বাবা দেখি কেমন হয়েছে?” 

ভালোবাসা দিবস, ঈদ কিংবা নিজেদের জন্মদিনে এমন পরিবারহীন মানুষদের সাথে কিন্তু উদযাপন করতেই পারেন। 

টিএইচ