চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসিসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা। তবে নিরপেক্ষতার আড়ালে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নিয়োগের পায়তারা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের যৌক্তিক আন্দোলনে যারা সমর্থন জানাননি বরং স্বৈরাচারি সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন তাদের কোনো অধিকার নেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব পালন করার। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এবং একাডেমিকভাবে যোগ্য এমন ব্যক্তিদের শীর্ষ পদে দেখতে চান শিক্ষার্থীরা।
গত ১৮ আগস্ট সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত সম্ভব আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। এটা একটা সুযোগও আমি মনে করব। আমরা চাইব, এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এতদিন এই জায়গাটায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ১২ আগস্ট পদত্যাগ করেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের। একই সময়ে পদত্যাগ করে দুই উপ উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে ও অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী। এরপর থেকেই পরবর্তী উপাচার্য কে হচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা।
শিক্ষার্থীদের শত প্রত্যাশা পূরণে আগামীর ভিসি ও প্রো-ভিসি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নাম শুনা যাচ্ছে। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হোসাইন, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল ফোরকান, লোক প্রশাসন বিভাগের আমির মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন ও অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম, সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস.এম.মনিরুল হাসান।
আবুল হোসাইন ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে বেশ কিছু কারণে বিতর্কিত। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রগতিশীল আওয়ামীপন্থি শিক্ষক সমাজ (হলুদ দলের) আহ্বায়ক। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে উপাচার্যপ্রার্থী ছিলেন অধ্যাপক আবুল হোসাইন। সেসময় শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং বিভিন্ন দপ্তরে দেন-দরবারর অভিযোগও মেলে তার বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে নানা কারণে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। তিনি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের প্রধান সমন্নয়কারী ছিলেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়ায় শিক্ষার্থীদের একটা অংশ তাকে ভিসি হিসেবে চাইছেন। এ ছাড়াও তিনি অধ্যাপকদের ভোটে নির্বাচিত প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্য হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যেও তার গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ্য করা গেছে। ক্যাম্পাসে তিনি শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষক হিসেবে বেশ পরিচিত। নিজ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন সময়ে তার ব্যাপারেই একাডেমিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশংসা শোনা যায়। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলন ও মানবাধিকার প্রশ্নে তাকে বেশ জোরাল ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও তাকে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। ভিসির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক শামীম।
ভিসি হওয়ার দৌড়ে আছেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল ফোরকান। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের অর্ন্তভুক্ত হলেও কখনো সক্রিয় ছিলেন না এ শিক্ষক। উল্টো হলুদ দলের শিক্ষকদের সঙ্গে ছিল তার বেশ সখ্যতা। শুধু তাই নয়, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ট হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন বেশ সুযোগ সুবিধা। ফলে অনেক অনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও পার পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নীরব ভূমিকায় ছিলেন তিনি।
আমির মোহাম্মদ নসরুল্লাহকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানাতে মরিয়া আওয়ামী লবি। তিনি লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক। তাকে ভিসি বানানোর জন্য কপি পেস্ট পোস্ট করানো হচ্ছে বিভিন্ন আইডি থেকে। তাদের শিক্ষার্থীদের দিয়েও পোস্ট করানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএনপিপন্থি প্রফেসর নছরুল কদিরের পিএইচডি ডিগ্রি না থাকার কারণে তার নাম বিবেচিত হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক পরিষদের দায়িত্বশীল একজন বলেন, নিরপেক্ষ বলে কোন শিক্ষক নেই সবাই কোনো না কোনো মতাদর্শের অনুসারী। সেই জায়গা থেকে স্বচ্ছতা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতার বিচারে অবশ্যই ড.শামীম উদ্দিন খান ভিসি পদের জন্য অগ্রাধিকার যোগ্য। তিনি শিক্ষক মহলেও ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্য। এ ছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সবার আগে তিনি জোরাল ভূমিকা পালন করেন এবং শিক্ষক ঐক্য গড়ে তোলেন। তিনি ভিসি হলে নিয়োগ বাণিজ্যমুক্ত ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
সফল গণঅভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন ভিসি চান এমন প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীবান্ধব ও নিরপেক্ষ ভিসি যাই। যিনি আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেশনজট মুক্ত করবেন। আমাদের ড. মোহাম্মদ ইউনূস স্যার এ ব্যাপারে যথেষ্ট অবগত আছেন তিনি যাকে ভালো মনে করেন তাকেই ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. মো. শহিদুল হক বলেন, উপাচার্য অবশ্যই এমন কেউ হবেন যিনি দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার ঊর্ধ্বে থাকবেন। এক কথায় নিরপেক্ষ থাকবেন। তার মাঝে অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী চেতনা রক্ত মাংসে লালন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়েছে দুটি বিষয়ের জন্য। একদিকে জ্ঞান চর্চা আরেকদিকে জ্ঞান সৃষ্টি। শিক্ষকতার কাজ এবং গবেষণার কাজ এ দুটোকে যারা এগিয়ে নিতে পারবেন একই সাথে প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, সাহসী, উদ্যোগী, উদ্যমী এরকম মানুষকেই চাই।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ সৎ, দক্ষ, মেধাবী এবং বাংলাদেশপ্রেমী অধ্যাপকবৃন্দকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য পদসমূহে বেছে নিবেন বলে সকলেই আশা করছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা ও ব্যঘাত ঘটেছে তা দূর করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুতই গতিশীল হয়ে ওঠবে বলে সকলেই আশাবাদী।
বর্তমানে চবিতে সহস্রাধিক শিক্ষক রয়েছেন। তাদের সকলকে ম্যানেজ করতে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ সকল মহলের নিকট গ্রহণযোগ্য ভিসি প্রয়োজন। গ্রেড-১ অথবা সিলেকশন গ্রেডের সিনিয়র অধ্যাপককে ভিসি না বানিয়ে জুনিয়র কাউকে বানালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়র মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান সকলকে নিয়ে চালানো কঠিন হয়ে পড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টিএইচ