কয়েকদিন ধরেই আলোচনায় রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ। ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা-রাজিয়ার অনুসারী ও বিদ্রোহী নেত্রীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ। সর্বশেষ কমিটি স্থগিত ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে রিভা অনুসারীদের মানববন্ধন স্থীরতা তৈরি করেছে ক্যাম্পাসে।
ইডেনে রিভার হিডেন বাণিজ্য ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ভুগতে হচ্ছে সামাজিকভাবে। এদিকে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে পারিবারের সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সিট বাণিজ্যসহ নানান বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন ছাত্রলীগ নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী। এরপরই তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে। নির্যাতনের ঘটনা জানাজানি হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। পরে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) তারা ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেন।
এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর মুখ ঢেকে মানববন্ধন করেছেন ইডেন কলেজে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। তবে সূত্র থেকে জানা যায়, পরিচয় গোপন করে মানববন্ধন করা শিক্ষার্থীরা ছিলো সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও রাজিয়া সুলতানার অনুসারী।
মানববন্ধনকারীরা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত নেত্রীবৃন্দের শাস্তির দাবি করেন। তারা এও দাবি করেন যে, বহিস্কৃত নেত্রীবৃন্দের করা অভিযোগের প্রমাণ থাকতে হবে। এই অভিযোগের কারণে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। এছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি যে রুমে থাকেন সেই রুমটি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার ৩০৯ নং রুম। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের এক সুত্র জানান, ওই ছাত্রী রাজিয়া সুলতানার অনুসারী।
এছাড়াও ঐশর্য মালাকার নামে এক শিক্ষার্থীকে এই মানববন্ধনের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। তিনি থাকেন রাজিয়া হলের ২০৪ নাম্বার রুমে। ওই রুম ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার নিয়ন্ত্রণাধীন।
এছাড়াও গোপন সুত্রে জানা গেছে এমন আরো অনেকেই ছিলেন ওই মানববন্ধনে, যারা কিনা ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীই না। তারপরও অবৈধভাবে তারা থাকছেন তামান্না জেসমিন রিভার ছত্রছায়ায়।
এ বিষয়ে কথা বলতে তামান্না জেসমিন রিভার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে রাজিয়া সুলতানার সাথে কথা বলতে চাইলে তার সাথেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ইডেনের অন্য কোন শিক্ষার্থীও গণমাধ্যম কর্মীদের কারো সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
যে সকল অভিযোগ উঠেছে তা নেহায়েত নতুন না। এমন সকল অভিযোগ অনেক আগে থেকেই শোনা গেছে বিভিন্ন সময়। এমনকি ইডেনের সাবেক অনেক শিক্ষার্থীই জানিয়েছেন ইতোপূর্বে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
এমন ঘটনা নতুন নয় বলে দাবি লিজা আক্তার হোসাইন নামে ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক এক ছাত্রীর।
নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে লিজা জানিয়েছেন, বর্তমানে কলেজটির যে চিত্র টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে, তা বহু পুরনো। এমন দৃশ্য তাকে প্রায়ই দেখতে হতো। কলেজটির পরিবেশকে জঘন্য বলে উল্লেখ করেছেন লিজা।
সাবেক এই শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি ইডেন থেকে বলছি। নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কখনো মুখ উচিয়ে গল্প করার মত কিছু বলতে পারিনি বন্ধুমহল কিংবা আত্মীয় কিংবা করপোরেটে।
পরীক্ষার সময়টুকু বাদ দিলে সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন ক্লাস করেছি। দুই-একজন ক্লাসমেটের সহযোগিতায় ক্লাসের আপডেট নিতাম আর পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিতাম।’
‘প্রাইভেটের খরচ চালানোর চাপ দিতে চাইনি বাবা-মাকে। তাই শত কষ্ট চুপচাপ মেনে নিয়ে চেষ্টা করেছি পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে। আজকে যা আপনারা টিভিতে নিউজে দেখছেন, এসব আমরা টুকটাক প্রায়ই দেখতাম।
জঘন্য এক পরিবেশের ভেতর, বিশেষ করে হলের ভেতর। জোর করে মেয়েদের রাজনীতিতে নামানো এবং রাজনীতি করা এখানকার শিক্ষাদান। যেন দলভারী করার জন্য এক ফ্যাক্টরি খুলে বসছে।’
এসব দেখে তার দম বন্ধ হয়ে আসতো বলে পোস্টে লিখেছেন লিজা। সাবেক এই শিক্ষার্থী তার পোস্টের শেষ দিকে লিখেছেন, ‘শেষ যেদিন কলেজে গিয়েছিলাম, সেদিনের দুটি ছবি খুঁজে পেলাম। এখন বুঝি, কেন টপ এক হাজারের মধ্যেও একটাও বাংলাদেশের কোনো ইউনিভারসিটির নাম নেই।’
এছাড়াও তামান্না জেসমিন রিভা ছাত্রীদের জোর করে মিটিং মিছিলে যোগদান করান এমন অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত একটি ভয়েস রেকর্ডিং ফাঁস হওয়ার পর নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছিলেন তিনি। তাই জোর করেই শিক্ষার্থীদের দিয়ে মানববন্ধন করাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নও থেকেই যায়।
এদিকে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী এসব নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অভিভাবকরাও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ইডেন সম্পর্কিত ট্রল এবং ফানি ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, যা নিছক মজার জন্য হলেও বাস্তবেও চিত্রটা অনেকটাই এমন।
ইডেনে পড়েন এমন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক সুত্রে জানা গেছে অনেকেই মেয়েদের বিয়ে নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন। অভিভাবকরা দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন নিজেদের সন্তানকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে ভুল করে ফেলেছেন কিনা।
সামাজিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীই শুধু ইডেনে পড়ার সুত্রে বয়ে বেড়াচ্ছেন অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার অপবাদ। তাই সন্তানদের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করছেন পরিবার। অথচ বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই নির্দোষ অথবা তাদের বাধ্য করা হয়েছিলো এসব করতে।
এসআর