ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সিরিয়ায় ২৫০ টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে বলে আলজাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।একটি ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র স্থানীয় মিডিয়াকে জানিয়েছে, আল-আসাদকে অপসারণের পর সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান হামলা চালিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রটি রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত ইসরায়েলি আর্মি রেডিওকে জানিয়েছে, ‘সিরিয়ায় ২৫০টিরও বেশি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা হয়েছে।’ সূত্রটি আরো যোগ করে বলেছে, লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘আসাদ সেনাবাহিনীর ঘাঁটি, বেশ কয়েকটি ফাইটার জেট, এয়ার মিসাইল সিস্টেম, প্রোডাকশন সাইট এবং গুদাম।’
সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স (হোয়াইট হেলমেট) জানিয়েছে, শহরের উপকণ্ঠে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এরপর দমকলকর্মীরা দামেস্কে আগুন নিভিয়েছে। তারা আরো জানান, শহরে বিষাক্ত গ্যাসের যে গুজব ছড়িয়েছে, তা সত্য নয়।
হোয়াইট হেলমেট এক্সর একটি পোস্টে জানিয়েছে, ‘আগুন নিভানোর সময় অস্বাভাবিক বিষাক্ত ধোঁয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আমরা নিশ্চিত করছি এবং বেসামরিকদের কেউ বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারাও যায়নি।
এদিকে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) সিরিয়ায় ইসরায়েলের আক্রমণ এবং বোমাবর্ষণের নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে ‘সিরিয়ার জনগণ বিদেশি দখলদারিত্ব ও সহিংসতা থেকে মুক্ত, তাদের দেশ আবার পুনর্গঠনের যোগ্য।’ গ্রুপটি এক্স-এর একটি বিবৃতিতে গাজায় গণহত্যা সত্ত্বেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারকে অস্ত্র পাঠানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নিন্দা করেছে।
সিএআইআর বলেছে, ‘আমরা যেমন খবর পেয়েছি তা হলো, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় যে হামলা চালিয়েছে, তা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিযানগুলোর মধ্যে একটি। সিরিয়ার গোলান মালভূমির জমিও দখল করেছে সেনাবাহিনী।’
এদিকে ইউকে-ভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক এসওএইচআর বলছে, উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার মানবিজ শহরের কাছে জারফান গ্রামে তুর্কি-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ)-এর হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছে। মার্কিন সমর্থিত কুর্দি-নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) থেকে তুর্কি-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি মানবিজের নিয়ন্ত্রণ দখল করার সময় এই হামলাগুলো হয়েছিল।
এসওএইচআর বলেছে, হামলার ফলে মানবিজের বাসিন্দারা ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এতে আরো যোগ করা হয়েছে, তুর্কি-সমর্থিত বাহিনী মানবিজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরে বেসামরিকদের সম্পত্তিতে হামলা চালিয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।’
এসওএইচআর আরো জানিয়েছে, পূর্ব সিরিয়ার আইন আল-আরব জেলার টারমি গ্রামে এসএনএর আর্টিলারি হামলায় দুটি শিশুও নিহত হয়েছে। এর আগে তারা এক প্রতিবেদনে বলেছিল, আল রাক্কার আইন ইসা গ্রামাঞ্চলে তুর্কি ড্রোন হামলায় ছয় শিশুসহ একই পরিবারের আরো ১১জন নিহত হয়েছে।
গোলানের বাফার জোন ইসরায়েলের দখলে:
গোলান মালভূমির অসামরিক বাফার জোন সাময়িকভাবে দখলে নিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ঘোষণায় এই দাবি করেন।
১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সমঝোতা চুক্তি বিদ্রোহীদের হাতে দেশটির নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার কারণে ‘ভেঙে পড়েছে’ বলে জাানান তিনি।
নেতানিয়াহু বলেন, গোলান মালভূমিতে ইসরায়েল অধিকৃত এলাকা থেকে বাফার জোন এবং আশপাশের কমান্ডিং অবস্থানগুলোতে ঢোকার জন্য তিনি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের সীমান্তে কোনো বৈরী শক্তিকে অবস্থান নিতে দেব না।’ যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, গত শনিবার বাফার জোনের ভেতরে অবস্থিত কুনেইত্রা প্রদেশ থেকে সিরীয় সেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। গত রবিবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বাফার জোনের ভেতরে থাকা পাঁচটি সিরীয় গ্রামের বাসিন্দাদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের বাড়িতে থাকতে বলেছে। গোলান মালভূমি দামেস্ক থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
১৯৭১ সাল থেকে বাশার আল-আসাদ এবং তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন। রবিবার ভোরে ইসলামপন্থী বিদ্রোহী সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন গোষ্ঠী দামেস্কে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হয়ে ‘সিরিয়া এখন মুক্ত’ বলে ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধারা রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে।এরপরই গোলান মালভূমির বাফার জোন দখলের পদক্ষেপ নেয় ইসরায়েল।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধ শেষে গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর ১৯৮১ সালে তারা এই অঞ্চলটিকে একতরফাভাবে নিজেদের অংশ বলে ঘোষণা করে। তবে ইসরায়েলের এ পদক্ষেপ কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। যদিও ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপকে স্বীকৃতি দেয়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আসাদ সরকারের পতনের দিনটিকে ঐতিহাসিক দিন বলে উল্লেখ করেছেন। নেতানিয়াহু বলেন, ‘দামেস্কে স্বৈরশাসক আসাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে এতে বিপদও রয়েছে।’ নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানে এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে তাদের হামলার কারণে সিরিয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেছে।
এদিকে আসাদ সরকারের পতনের পর রাশিয়ার মস্কোতে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাসে বিদ্রোহীদের তিন তারকাবিশিষ্ট পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অবস্থিত সিরিয়ার দূতাবাস থেকে সিরিয়ার জাতীয় পতাকা সরিয়ে ফেলা রয়েছে।
অন্যদিকে আসাদ সরকারের আমলে গুম হওয়া অনেকের স্বজনরা প্রিয়জনের খোঁজে দামেস্কের শহরতলিতে অবস্থিত সেদনায়া কারাগারের সামনে ভিড় জমিয়েছে। আসাদের পতনের পর ওই কারাগারে ঢুকে বন্দিদের মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্রোহীরা।
সিরিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দিনে সেখানে ইসলামিক স্টেটের ৭৫টিরও বেশি কৌশলগত স্থাপনা লক্ষ্য করে আকাশপথে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে বাশার আল-আসাদ পালিয়ে মস্কোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ব্যক্তিগতভাবে বাশার আল-আসাদকে মস্কোয় আশ্রয় দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, পুতিন ও আসাদের মধ্যে কোনো বৈঠক হওয়ার কথা নেই। আসাদ কোথায় আছেন সে বিষয়েও কিছু বলার নেই। আসাদকে কিভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে পেসকভ বলেন, রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এটা তার সিদ্ধান্ত। রাশিয়ার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক মিখাইল উলিয়ানভ গতকাল সোমবার নিশ্চিত করেছেন, আসাদ ও তার পরিবার মস্কোতে রয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, রাশিয়া কঠিন পরিস্থিতিতে তার বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। সূত্র : এএফপি, আলজাজিরা।
টিএইচ