দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ অবসরে যাওয়ার আগের পাঁচমাস দুদকে যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং যেসব অভিযোগ ‘পরিসমাপ্তি’ ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব অভিযোগের রেকর্ড (নথি) চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে এসব নথি দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সংস্থাটির দাখিল করা প্রতিবেদন দেখে রোববার (২২ জানুযারি) এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ। আইন অনুসরণ করে পদ্ধতি মেনে এসব অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কিনা, তা দেখতেই এ নথি চাওয়া হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
‘দুদকে ‘অনুসন্ধান বাণিজ্য’ শিরোনামে ২০২১ সালের ১৪ মার্চ প্রতিবেদন প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিক। প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর ১৬ মার্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেন হাইকোর্ট।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ অবসরে যাওয়ার আগের পাঁচমাস (২০২০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত) দুদকের অনুসন্ধান থেকে কত জনকে, কেন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয় আদেশে। সেই সঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবেদক সাঈদ আহমেদ খানকে এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যা আদালতে দাখিল করতে বলা হয়।
রোববার (২২ জানুযারি) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান সে প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। এসময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। আর সাংবাদিক সাঈদ আহমেদ খানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত না হলে অভিযোগটি ‘পরিসমাপ্ত’ করা হয়। এটি কমিশনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে উল্লেক করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমাদের দাখিল করা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আদালত বলেছেন যে, যে অভিযোগুলো পরিসমাপ্ত (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে) ঘোষণা করা হয়েছে, সেই পরিসমাপ্ত অভিযোগগুলোর রেকর্ডগুলো দেখেতে চেয়েছেন আদালত।’ তদন্ত ও পরিসমাপ্ত মিলিয়ে মোট ৪৭৩টি অভিযোগের রেকর্ড আদালত দেখতে চেয়েছেন বলে জানান এই আইনজীবী।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ অবসরে যাওয়ার আগের পাঁচমাস ৪ হাজার ৪৮১টি অভিযোগ থেকে চার শতাধিক অভিযোগ পরিসমাপ্ত ঘোষণা করেছে দুদক। পরিসমাপ্তি বা অব্যাহতির একটা আইনি পদ্ধতি আছে। এসব পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে কিনা আদালত মূলত সেটি দেখতে চেয়েছেন। আর যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে সেসব মামলার অগ্রগতি অর্থাৎ কোনটা কী পর্যায়ে আছে সেটিও দেখতে চেয়েছেন আদালত। যে কারণে এ সংক্রান্ত সমস্ত নথি দাখিল করতে বলা হয়েছে।’
আদালতের এ আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ বার্তা বাহকের মাধ্যমে দুদকে পৌঁছে দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
দুদকের প্রতিবেদনে অসঙ্গতি, আদালতের প্রশ্ন আদালতে উপস্থাপন করা দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অভিযোগসমূহ যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের জন্য কার্যক্রম গ্রহন করে। ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাসে পূর্বের জেরসহ মোট ৪ হাজার ৪৮১টি অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন ছিলো।
নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরনপূর্বক কমিশন এই সময়ে অর্থাৎ উক্ত পাঁচ মাসে ১৫৪টি অভিযোগের বিপরীতে মামলা দায়েরের ও সুনিদ্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের অভাবে ৪০৮টি অভিযোগ পরাসমাপ্তির সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ২টি অভিযোগ অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। একই সময়ে গত বছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত পূর্বের জেরসহ মোট ১ হাজার ৫৭৮টি মামলা তদন্তাধীন ছিল। এর মধ্যে ৫৭টি মামলার এফআরটি (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিল ও ১৬৫টি মামলার চার্জশিট দাখিলের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ৬টি মামলা অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। কমিশনের সকল সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিক্রমে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে গ্রহন করা হয়। এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের সুযোগ নেই।
তবে নানা অসঙ্গতির কারণে দুদকের এ প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। আদালত বলেন, প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা ১ হাজার ৬৭৮টি মামলার তদন্তের কথা। কিন্তু সেটা কেটে হাতে লিখে দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৭৮টি। আবার ৬৫টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলা হলেও সেটাও কাটাছেঁড়া করে হাতে লিখে ৫৭টি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৫৭টি মামলার চার্জশিট দাখিলের কথা বললেও তা কেটে হাতে লিখে ১৬৫টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কেন? আমরা কোন তথ্যটি আমলে নেব? এরপরই হাইকোর্ট তদন্ত ও পরিসমাপ্ত মিলে ৪৭৩টি অভিযোগের নথি প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেন।
ইকবাল মাহমুদ ২০১৬ সালের ১০ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন। প্রায় পাঁচ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করে ২০২১ সালের ১০ মার্চ তিনি বিদায় নেন।
টিএইচ