রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
The Daily Post

হাই হিল কিভাবে পুরুষের পা থেকে নারীর পায়ে এলো?

জীবনযাপন ডেস্ক

হাই হিল কিভাবে পুরুষের পা থেকে নারীর পায়ে এলো?

বেশ চমকে যাওয়ার মতো হলেও ব্যাপারটি আসলেই সত্যি! বর্তমানে নারীদের ফ্যাশনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও প্রথম দিকে হাই হিল জুতা তৈরি করা হতো পুরুষদের পরার জন্য। নানান সুবিধা-অসুবিধার ঊর্ধ্বে প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভব ঘটিয়েছিলো হাই হিল ফ্যাশনের। সময়ের বিবর্তনে পা বদলের পাশাপাশি বদলেছে হাই হিল ব্যবহারের জায়গা ও উপাদান। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই একটি দরকারি টুল্স হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েরই পায়ের পরিধেয়ের স্বতন্ত্র সংযোজন ছিলো হাই হিল। চলুন, পুরুষের পা থেকে নারীর পায়ে হাই হিলের এই স্থানান্তরের ঘটনাটি জেনে নেয়া যাক।

হাই হিল ফ্যাশনের গোড়াপত্তন

ইতিহাসের সর্বপ্রথম দশ শতকের প্রাচীন ইরান বা পারস্যের অশ্বারোহী সৈন্যরা হাই হিল জুতা পরতো। ঘোড়াতে চড়ার সময় ভূমি থেকে পা কে উঁচু রাখার জন্য তারা এ ধরনের বিশেষ জুতাটি ব্যবহার করতো। এছাড়া এটি তাদেরকে ছুটন্ত ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় তীর-ধনুক ও গুলি চালানোর সময় জুতার ভেতর তাদের পা কে ধরে রাখতো। ফলশ্রুতিতে সে সময়কার পারস্যের সাধারণ অশ্বারোহীরাও এক ইঞ্চি হাই হিল জুতা পরা শুরু করে।

ইতিহাস জুড়ে পুরুষের হাই হিল চর্চা

শিল্প যুগের আগের সময়ে একটি ঘোড়ার মালিক হওয়া ঐশ্বর্য্যের পরিচয় ধারণ করতো, কারণ ঘোড়ার দেখাশোনা বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এর ফলে হাই হিল পরিধানকারীর ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতো।

১১ শতকের গোড়ার দিকে হাই হিল পরার জন্য স্বনামধন্য ছিলেন গ্রেট স্কিজমের পোপগণ, যারা লাল রঙের হাই হিল জুতা পরতেন।

পারস্য সৈন্য ও অভিবাসীরা হাই হিল জুতার চর্চাকে ইউরোপে নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে হাই হিল ফ্যাশনের জন্ম দিয়েছিলো। ইউরোপীয় অভিজাত ব্যক্তিরা নিজেদের লম্বা দেখানোর জন্য একটি শক্তিশালী সামরিক কৌশল হিসেবে এই নতুন ধারাটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে।

ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই হাই হিলের রাজা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর শাসনামলে মনে করা হতো- যে হিল যত উঁচু ও লাল হবে, পরিধানকারী তত বেশি শক্তিশালী হবে। তিনি ১৬৭০ সালে একটি আইন পাস করেন যে, শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরা হাই হিল জুতা পরতে পারবে। রাজা নিজে লাল রঙের হিল বা সোলের জুতা পরার পাশাপাশি তাঁর দরবারের লোকদেরও লাল হিল পরার অনুমতি দিতেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়েই ৯০ দশকে জুতার ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবউটিন বিশ্ব জোড়া খ্যাতি পেয়েছেন।

১৭ শতকে ম্যাসাচুসেটসে একটি অদ্ভূত আইন প্রবর্তন হয়। যে মহিলারা হাই হিল জুতা ব্যবহারের মাধ্যমে পুরুষদের প্রলুব্ধ করবে, তাদেরকে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে।

১৮ শতকে ইউরোপ জুড়ে রেনেসাঁ এবং ইনলাইটেনমেন্ট বিপ্লব শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুরুষদের হিল পরার প্রবণতা কমে যেতে শুরু করে। শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থা প্রদর্শনের জন্য হাই হিল পরা এ সময় অযৌক্তিক হিসেবে গণ্য হয়েছিলো। ১৭৪০ সালের মধ্যে পুরুষরা হাই হিল জুতা পরা বন্ধ করে দেয়।

নারীর পায়ে হাই হিল

নারীর পায়ে হাই হিলের সবচেয়ে পুরাতন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১২ শতকে ভারতের রামাপ্পা মন্দিরে একজন ভারতীয় নারীর ভাস্কর্যতে।

১৪০০-এর দশকে ইউরোপের মহিলারা বিশেষ করে স্পেন ও ভেনিসে উচু প্ল্যাটফর্ম যুক্ত এক বিশেষ ধরনের জুতা পরতেন যাকে চপইন বলা হতো। এগুলো মূলত এক ধরনের খড়ম, যা পা কে রাস্তায় জমে থাকা নোংরা ও আবর্জনা থেকে বের করে আনার জন্য সাধারণ জুতার উপরে পরা হত।

ফরাসী রানী ক্যাথরিন ডি মেডিসি প্রথম নারী যিনি হাই হিল পরতেন। সময়টি ছিলো ১৫০০ দশকের মাঝামাঝি পর্যায়। এর আগ পর্যন্ত মহিলারা শুধুমাত্র চপইন পরতেন।

১৮ শতকে প্রথমবারের মত সাধারণ মহিলারা হাই হিল ফ্যাশন চর্চা করতে শুরু করে।

নারীর সৌন্দর্য্যের ধারক হয়ে হাই হিলের পুনরুত্থান

পুরুষের পা থেকে হাই হিল নারীদের পায়ে যাবার পেছনে মুলত ইনলাইটেনমেন্ট বিপ্লব-ই দায়ী।

১৮৫০-এর দশকে সেলাই মেশিনের উদ্ভাবন ও ব্যাপক উৎপাদনের ফলে হাই হিলগুলোরও ব্যাপকভাবে উৎপাদন ঘটে। এতে হাই হিল জুতার খরচ যথেষ্ট কমে আসার কারণে জনসাধারণের মাঝেও হাই হিল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থাকে।

বিংশ শতাব্দিতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রের বদৌলতে মহিলাদের হাই হিলের পশ্চিমা ফ্যাশন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নগ্ন পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে একত্রিত কাটআউট বা গোড়ালির স্ট্র্যাপ সহ বাদামী ও সাদা পাম্প জুতাগুলো ছিল মহিলাদের হাই হিল ফ্যাশনের কেন্দ্রবিন্দু।

হাই হিলের জুতাগুলো পশ্চিমের অনেক মহিলার জন্য পেশাদারিত্বের প্রতীক হওয়া শুরু করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পিন-আপ গার্ল-এর পোস্টারগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এই পোস্টারের মুল বিষয়ই ছিলো একজন হাই হিল পরিহিত মহিলার ছবি। এ সময় পিন-আপ গার্লের সংবেদনশীল ছবির জনপ্রিয়তা ছেড়ে যায় গোটা ইউরোগ-আমেরিকায়। এরই সূত্র ধরে ১৯৫০ সালে আগমন ঘটে লম্বা, চর্মসার স্টিলেটো হিল। এই নজরকাড়া হাই হিল জুতাটি ক্রমেই নারীত্বের প্রতীকে পরিণত হয়।

সে সময়ের বিখ্যাত তারকা মেরিলিন মনরো ও অড্রে হেপবার্নকে দেখা যেতে থাকে স্টিলেটো-হিল জুতা পরিহিত অবস্থায়। ফলশ্রুতিতে বিশ্ব জুড়ে নারীদের মাঝে হাই হিলের প্রতি আকর্ষণ বহুগুণে বেড়ে যায়।

১৯৮০’র দশকে অবদমিত অবস্থা থেকে হাই-হিল ফ্যাশনকে টেনে তুলেছিলো মানোলো ব্লাহনিকের মতো ডিজাইনাররা। হাই হিলের রীতিমত পুনরুত্থান হয় যখন এদের পাশাপাশি ম্যাডোনার মতো বিখ্যাত তারকারা প্রসাধনীর পরিবর্তে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসাবে হাই হিলযুক্ত জুতা এবং বুট পরা শুরু করে।

যুদ্ধ, আইন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক বিপ্লব পেরিয়ে এভাবেই হাই হিল জুতা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। কালক্রমে ফ্যাশন প্রবণতা পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে হাই হিল পৌরুষ দ্বীপ্ত ও জৌলুস প্রতাপ থেকে নিজের অবস্থান খুঁজে নিয়েছে নারীর সৌন্দর্য্যের অববাহিকায়। এখন নারীর দেরাজের অবধারিত সংযোজন হিসেবে শোভা পায় হাই হিল জুতা।

এসএম