সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১
The Daily Post

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, মানবাধিকারের চরম উলংঘন

শাহরিয়ার রহমান

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, মানবাধিকারের চরম  উলংঘন

বাংলাদেশ ও ভারত পরষ্পর নীর্ভরশীল দুটি প্রতিবেশী দেশ। পারষ্পরিক প্রায় মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা রক্ষা করে দুটি দেশ। দুটি দেশের মধ্যেই একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কুটনৈতিক সম্পর্কও এ দুটি দেশের মধ্যে বেশ ভালো। তবে প্রতিবেশী দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যার ঘটনা প্রায়সই ঘটে চলেছে। উইকিপিডিয়ার একটি তথ্য বলছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগ আছে। অধিকার, একটি বাংলাদেশি এনজিও, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী দ্বারা কমপক্ষে ১৭ বাংলাদেশি হত্যা ও বিভিন্ন নির্যাতনের দৃষ্টান্ত নথিভুক্ত করে। মাসুম, একটি কলকাতা ভিত্তিক এনজিও যারা সীমান্ত এলাকার তথ্য উদ্‌ঘাটন করে, তাদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় গুলি চালনার হার কমলেও বিএসএফ সন্দেহভাজনদের আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন, নিষ্ঠুরভাবে প্রহার এবং নির্যাতন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে সীমানে ফেলানী কে হত্যা করে সীমান্তের কাটাতারে ঝুলিয়ে রাখা। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, হাট-বাজারে বেচাকেনা করা, এবং কাজ খোঁজার জন্য অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিজমিতে কৃষিকাজ কিংবা নদীতটে মৎস্য আহরণের জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্তপথ অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন ছোটখাটো এবং গুরুতর আন্তঃসীমান্ত অপরাধে নিয়োজিত। সীমান্ত বাহিনী অবৈধ কার্যক্রম মোকাবেলার বাধ্যতামূলক করা হয়, বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য মানব পাচার, এবং জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহন। ২০১১ সালের জুলাইয়ে হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচ সীমান্ত হত্যা নিয়ে বলে, "ভারত সরকারের বাংলাদেশের সীমান্তে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) দ্বারা হত্যা, নির্যাতন, ও অন্যান্য অনাচারের নতুন অভিযোগ একটি, দ্রুত পরিষ্কার, এবং স্বচ্ছ অপরাধের তদন্ত দায়িত্বগ্রহণ করা উচিত।" হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক, মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, "সীমান্তে মানুষের উপর অত্যধিক বল ব্যবহার ও নির্বিচারে প্রহার অসমর্থনীয়। এইসব নির্যাতনের ঘটনা ভারতের আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।

 

বিগত ১০ বছরে প্রায় ১,০০০ মানুষ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নিহত হয়, যার বেশিরভাগই বাংলাদেশি। সীমান্ত এলাকাকে একটি দক্ষিণ এশিয়ার হত্যার ক্ষেত্রে পরিণত করে। অনেক ক্ষেত্রে নিরস্ত্র এবং অসহায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার প্রমাণ সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত কাওকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি।

মানবাধিকার সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ বছরের মধ্যে (২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে প্রায় ১০০০ বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০৬৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে বিএসএফ গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করেছে ৪২ জন বাংলাদেশিকে।

 প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী নিয়মিত হুমকি দেয়, নির্যাতন করে এবং সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয় বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিকদের আটক করে নির্যাতন করে এবং বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষী বাহিনী সাধারণত বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিকদের সাহায্য করে না। অধিকার, বাংলাদেশ ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ করেছে যে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ ধর্ষণ ও লুটপাটের শিকার হয়েছে।

অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩শ ১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়।

জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৫ জনকে। এ সময় বিএসএফ ২২ বাংলাদেশীকে গুলি ও নির্যাতন করে আহত করেছে আর অপহরণ করেছে ৫৮ জনকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৭ দিনের ব্যাবধানে ভারতীয়রা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ৩ বাংলাদেশীকে জোর-জবরদস্তি অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ আহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে৷ তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে৷  ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫জন বাংলাদেশিকে

ব্যাড এডামস, হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচের এশিয়া বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে বলেন,

"Routinely shooting poor, unarmed villagers is not how the world‍‍`s largest democracy should behave."

ভারতীয় কর্মকর্তারা বিএসএফ-এর আচরণের পরিবর্তন এবং শ্যূট-অন-সাইট নীতি বাতিল করতে নতুন আদেশ পাঠাতে অঙ্গীকার করেছেন। তারা অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারকারী বা পাচারকারীদের ধরতে অহিংস উপায় ব্যবহার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। যদিও তা এখনোও বাস্তবে কার্যকর হয়নি।

বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের শ্যূট-অন-সাইট নীতি অভিযোগের প্রতিক্রিয়া বিভ্রান্তিকর: "আমরা অবৈধ সীমান্ত পারাপারকারীদের গুলি করি যেহেতু তারা আইনভঙ্গকারী; আমরা সীমান্ত পারাপারকারীদের গুলি করি না; আমরা কেবল আত্মরক্ষাতে গুলি করি; আমরা হত্যা করতে গুলি করি না।"

বিএসএফ-এর মত কোনও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধের তদন্ত শুরু করার জন্য একটি ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তার অনুমতি প্রয়োজন, যা খুব কমই ঘটে।

ভারতে একটি কার্যকরী আদালত থাকলেও, সীমান্তের এসব অপরাধের ক্ষেত্রে দৃশ্যতঃ বিএসএফ একইসাথে বিচারক, জুরি এবং ঘাতক হিসাবে কাজ করতে পারে।

ভারত তার সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ভারতে প্রাণঘাতী বল ব্যবহার করার অধিকার নেই। তবুও কিছু ভারতীয় কর্মকর্তা প্রকাশ্যে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন।

বিএসএফ-এর প্রাক্তন প্রধান রমণ শ্রীবাস্তব বলেন যে, কোনও মানুষের উচিত নয় এই শিকারগ্রস্তদের জন্য দুঃখ বোধ করা। তিনি দাবি করেন যে, যেহেতু এইসব ব্যক্তি প্রায়শই রাতে, অবৈধভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করছিল, তাই তারা মোটেই "নির্দোষ" ছিল না এবং এ কারণেই এরা বৈধ লক্ষ্য ছিল। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সহস্রাধিক ভারতীয় চোরাচালানকারী বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-র দ্বারা আটক হলেও হত্যার ঘটনা একটিও নেই। বরং অনেক কেই ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ পতাকা বৈঠক (ফ্ল্যাগ মীটিং) এর মাধ্যমে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে নিজ দেশে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সাল থেকেই শুরু হয় বিএসএফ এর সীমান্তহত্যা। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৭২ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিএসএফ হত্যা, গুম অথবা আহত করেছে মোট ৫০৮৪ জন কে। ঊল্লেখ্য যে ২০০০ সাল থেকে এর মাত্রা বেড়েছে। এর আগে শুধুমাত্র গুলি করে হত্যার ঘটনা থাকলেও ২০০০ সালের পর অপহরণ, গুম, আহত, নির্যাতন এবং ধর্ষণের মত নিকৃষ্টতম অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল এর মধ্যে ১৮৬০ জনকে নিহত, ১১৪৫ জনকে আহত (গুলি করে), ১১১ জনকে গুম, ১৫ জনকে ধর্ষণ, ১৫৭ জনকে ছিনতাই, ৩৫৪ জনকে পুশইন ও অন্যান্য ভাবে ৩৪ জনকে হত্যা করে বিএসএফ।

এ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলে, “কেউ যদি দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, তবে তাকে ধর্ষন করা নিকৃষ্টতম অপরাধ।“  তবে সাধারণ নাগরিক ঠিকই এর প্রতিবাদ করেছে। ২০১২ সালে আলোচিত ফেলনী হত্যার পর বাংলাদেশ ও ভারত জড়িয়ে পরে সাইবার যুদ্ধে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া ইয়াহু নিউজ জানায় প্রায় ২০০০০ সরকারী ও বেসরকারী ওয়েবসাইট হ্যাক করে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার প্রতিবাদ জানানো হয়। সমসাময়িক ভাবে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা কমে গেলেও তা এখনো চলমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ বিষয়ে ভারতের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে বাংলাদেশের । তবে এ নিয়ে কখনো কোন বিচার হবে কিনা তা’ও ধোয়াশার আড়ালে।