বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে অর্জন ছিল তা অতিরঞ্জিত বলে মনে করে গত ১৬ বছরের দুঃশাসনের সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ব্যতিক্রমী হলেও তা ছিল এক অলীক বিষয়। এ সময় জনগণকে এক ধাঁধার মধ্যে ফেলে ‘উচ্চতর প্রবৃদ্ধি’র কাল্পনিক গল্প শোনানো হয়। পরিসংখ্যান জালিয়াতির প্রচুর আলামত পেয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল বেশি। কমিটি মনে করে, রাজনৈতিকভাবে বাহাবা পাওয়ার জন্য জিডিপির হার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে যা, বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তথ্য-উপাত্ত নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হলে বোঝা যায়, এই পরিসংখ্যান ভুল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান মেলে না, এই অভিযোগ অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সংবাদকর্মীরা প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে এই উচ্চহারের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির পরিস্থিতি নিরূপণ এবং গত ১৬ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে শ্বেতপত্র কমিটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করেছে। তারা বলেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন পর্যালোচনা ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারিভাবে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই কেবল তা করা হয়েছে। শুধু সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে দেখা গেছে, দুঃসময় বা দুর্যোগের সময়ও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল অত্যন্ত চাঙা।
আর্থিকখাতের পরিসংখ্যান কারসাজির বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র্যাপিড’র চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক বাসসকে বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিকখাতের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তার হিসাব নিয়ে আগে থেকে সন্দেহ করা হচ্ছিল। রাজনৈতিক স্বার্থে পরিসংখ্যান কারসাজি করা হয়েছে এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এই কারসাজি চমৎকারভাবে উন্মোচন করেছে’।
তিনি বলেন, উন্নয়নের যে গল্প শোনানো হয়েছে, তাও বাস্তবিক ছিল না। সেটি ছিল অলীক। এখন থেকে যেন প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সরকারকে সেই পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান তিনি।
শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনের ভাষ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিরূপণের বিভিন্ন মডেল আছে, যেসব মডেলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের মধ্যে তাত্ত্বিক সম্পর্ক থাকে যেমন- শ্রম, পুঁজি, উৎপাদনশীলতা। কিন্তু এসব প্রথাগত মডেলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির উচ্চহার ব্যাখ্যা করা যায় না। ফলে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করছে, এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পক্ষপাত ছিল।
কোভিড-১৯ মহামারির যে সরলরৈখিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তথ্য-উপাত্ত ও পদ্ধতিগতভাবে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই সরলরৈখিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রচারণার স্বার্থে রাজনৈতিক কর্তা ব্যক্তিরা প্রবৃদ্ধির গতি বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক কর্তা সবচেয়ে উৎসাহী ও প্রভাবশীল ছিলেন, তার প্রস্থানের পরও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মধ্যে সেই রেশ থেকে গিয়েছিল। ওপর মহলের ক্রোধের ভয়ে পরিসংখ্যান ব্যুারো ধারাবাহিকভাবে ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশ করে গেছে।
টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে বিবিএসের তথ্য-উপাত্তের যে পর্যালোচনা হতো, ২০১৫ সালের পর তা একেবারে ভেঙে পড়ে।
শ্বেতপত্র কমিটি দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক প্যানেল ডেটা ব্যবহার করে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারির চার-পাঁচ বছর আগেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে গিয়েছিল। কমিটি গত ১৬ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা গেছে, এই সময় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে আনুষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম ছিল। এই প্রবণতা উত্তরোত্তর কেবল বেড়েছে। অর্থাৎ এই বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে বিশ্বব্যাংকও সময়-সময় আপত্তি তুলেছে। বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির তথ্যগত পার্থক্য ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও ‘লোটাস কামাল’ ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।
দেখা যায়, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও কর-জিডিপির অনুপাত বাড়েনি। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি বেশি হলে বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয় যেমন ভালো হয়, তেমনি কর্মসংস্থানেও গতি থাকে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে এসব সূচকের মিল ছিল না।
কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, মাথাপিছু জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি আর্থিকখাতের অন্যান্য পরিসংখ্যান কারসাজির আলামত পেয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। রাজনৈতিক সুবিধা ও আন্তর্জাতিকভাবে বাহাবা নেওয়ার জন্য এই মিথ্যা পরিসংখ্যান জাতির কাছে প্রকাশ করেছে তৎকালীন সরকার। -বাসস
টিএইচ