দেশের একমাত্র ও অনন্যসুন্দর প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপটিকে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ বলা হয়ে থাকে। জীব বৈচিত্র ও পর্যটনসহ নানাবিধ কারণে অনেক আগে থেকেই এই দ্বীপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিতেও এই অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে সেন্টমার্টিন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- সেন্টমার্টিন দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। তবুও সেন্টমার্টিন নিয়ে আলোচনা যেন থামছেই না। প্রবাল দ্বীপটি নিয়ে রাজনীতির টেবিলে চলছে তুমুল আলোচনা।
গত ১৪ জুন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে পাওয়ার লক্ষ্যে চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এজন্য তারা রেজিম চেঞ্জ (সরকার হটানো) চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন নেই।’ এরপর গত বুধবার (২১ জুন) একই বিষয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কোনো দেশের নাম না উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এখনও যদি বলি, সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনো অসুবিধা নেই, আমি জানি সেটা। তবে আমার দ্বারা সেটা হবে না। আমাদের দেশের মাটি ব্যবহার করে কোনো জায়গায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে, সেটি হতে দেব না।’
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরই মূলত সেন্টমার্টিন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা চলছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন সবাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কে এম আজদ চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনের মতো অফসোর দ্বীপ থাকার কারণেই সমুদ্র নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ অনেক বড় সমুদ্র অঞ্চল পেয়েছে। সেন্টমার্টিন না থাকলে বাংলাদেশ এত বড় সমুদ্র অঞ্চল পেত না। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে মোট ৮টি দেশ থাকলেও উত্তরাঞ্চলে তিনটি দেশ আছে। এই ৩ দেশের মধ্যে একটি মিয়ানমার, বেশিরভাগ অঞ্চল ভারতের এবং বাকিটা বাংলাদেশের।
সমুদ্রপথে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় যাতায়াতের জন্য যে ওপেন সী বা উন্মুক্ত সাগর, সেটি সেন্টমার্টিন থেকে সহজেই ব্যবহার করা যাবে। সেন্টমার্টিনে কেউ অবস্থান নিতে পারলে সেখান থেকে পুরো ভূ-খণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এই দিক থেকে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সেন্টমার্টিনের জীব-বৈচিত্র এবং প্রাকৃতিক যে সম্পদ রয়েছে তার গুরুত্বও অনেক। পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান থেকেও সেন্টমার্টিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আন্দামান নিকোবর দ্বিপ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে সেন্টমার্টিন নিয়ে মিয়ানমারের একটা টার্গেট আছে এবং তারা অতীতে একাধিকবার সেন্টমার্টিন দখলের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুযোগ পায়নি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বর্তমানে ভূ-রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের কেন্দ্রে অবস্থান করছে দক্ষিণ এশিয়া। আর বঙ্গোসাগর দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুর মত কাজ করছে। এই অঞ্চলটি এখন বাণিজ্যিক রুটসহ ভূ-রাজনীতিতে সংযোগ স্থাপনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
হঠাৎ যুদ্ধ লাগলে এই অঞ্চল দিয়ে সংযোগ স্থাপন সহজ হবে। সেদিক থেকে সেন্টমার্টিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বীপটি যদি যুক্তরাষ্ট্র নিতে পারে তবে তারা এখান থেকে চীন ও ভারত নিয়ন্ত্রণসহ এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আবার চীন নিতে পারলে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিতে চায়।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের আরসা অস্ত্র কোথা থেকে পায়? খোঁজ নিলে দেখবেন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অস্ত্র দেয়। আর সেন্টমার্টিন যদি যুক্তরাষ্ট্র একবার নিতে পারে তবে আজীবনের জন্য তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
টিএইচ