সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১
The Daily Post

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা: বন্যা পরবর্তী কৃষকদের জন্য করণীয়

ড. মো. শাহ কামাল খান

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা: বন্যা পরবর্তী কৃষকদের জন্য করণীয়

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, মৌসুমি ঝড়, সামুদ্রিক ঝড় প্রভৃতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের চারণভূমি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা অন্যতম। যখন কিনা সাড়ে পনেরো বছরের নির্যাতিত নিপীড়িত মুক্তিকামী প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অগ্রদূত হিসেবে কোটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কগণের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সর্বস্তরের জনগণকে সাথে নিয়ে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার তাজা রক্তের বিনিময়ে ২০২৪ এর ৫ই আগস্টে অর্জিত বাংলাদেশের ২য় ও প্রকৃত স্বাধীনতার খুশিতে সারাদেশের আপামর জনসাধারণ আনন্দ জোয়ারে ভাসছিল ঠিক তখনি সব আনন্দ ভেসে নিয়ে গিয়ে ম্লান করে দিল আকস্মিক আগ্রাসী বন্যা।

২০২৪-এর বন্যার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নতর। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয়া এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা। যেমন: ফেনি, কুমিল্লা, সিলেট, মৌলভিবাজার, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, লক্ষিপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার বন্যায় প্লাবিত হয়। এ ধরনের বাঁধ খুলে দেয়ার আগে প্রতিবেশী বা নিম্নাঞ্চলের দেশকে অবগত করার আন্তর্জাতিক বিধান থাকলেও ভারত তা অনুসরণ করে নি যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাঁধ খুলে দেয়া এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্লাবিত হয় এলাকার পর এলাকা, সৃষ্টি হয় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসে ঘোর কালো অন্ধকার, শুরু হয় মানবেতর জীবন।

বাঙালি পরাজিত হবার জাতি নয়। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত এ বন্যা মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকারের বহুমুখী সাহসী পদক্ষেপ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা প্রশংসনীয়। ছাত্র সমাজের পাশাপাশি বন্যার্তদের পাশে সর্বস্তরের মানুষ। “মানুষ মানুষের জন্য...” ভুপেন হাজারিকার সেই অবিস্মরণীয় সুর যেন বাজছে দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা, বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঝেঁপে পড়েছে ভয়াবহ বন্যাক্রান্ত মানবেতর জীবন অতিবাহিত করা অসহায় মানুষগুলোর পাশে। সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর ছাত্র-জনতার সংগ্রামে নবজন্ম লাভ করা এই বাংলাদেশ।

দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ দেশ গড়ার কারিগর মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে নিঃসন্দেহে আমরা স্মরণকালের এ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ জয় করবো ইনশাআল্লাহ।

স্থাপনা, রাস্তাঘাটের পাশাপাশি কৃষির ফসল, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ সেক্টরসমূহের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই এদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কৃষির উপরই নির্ভর করে দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য নিরাপত্তা। দেশের ৫১ টি জেলার সার্বিক কৃষির পরিস্থিতি সন্তোষজনক হলেও বন্যাক্রান্ত ১১ টি জেলার কৃষি কোথাও কোথাও আংশিক এবং কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চ্যালেন্জ।

এমতাবস্থায় বন্যাক্রান্ত জেলাসমূহের কৃষি সেক্টরের ক্ষতি পুশিয়ে নিতে হাতে নিতে হবে বিশেষ কর্মকাণ্ড, সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় সফল বাস্তবায়ন করতে হবে সময়োপযোগী বিশেষ পরামর্শ।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে বিধায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে। বন্যা পরবর্তী সময়ে বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমন ধানসহ অন্যান্য ফসল, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ রক্ষার জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শসমূহ অনুসরণ করা জরুরি।

ফসল সেক্টরের জন্য পরামর্শসমূহ :

১. বন্যা উপদ্রুত সকল এলাকায় ব্রি উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল উফশী জাত যেমন- বিআর৫, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৬, ব্রি ধান৫৪ এবং আলোক সংবেদনশীল স্থানীয় জাত যেমন নাইজারশাইল, রাজাশাইল, কাজলশাইল ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বপন এবং ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে রোপণ করতে হবে।

২. বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন- ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, বিনা ধান-৭ এবং বিনা ধান-১৭ সরাসরি বপন পদ্ধতিতে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত শুধু নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যা আক্রান্ত এলাকায় চাষ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য বন্যা উপদ্রুত কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্বপ্ন জীবনকালীন জাত এ মুহূর্তে চাষ করা যাবে না।

৩. যেসব এলাকায় বীজতলা করার উঁচু জমি নেই সে সমস্ত এলাকায় ভাসমান বা দাপোগ বীজতলা অথবা ট্রেতে চারা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪. বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার পর যেসব ক্ষেতের ধান গাছ বেঁচে আছে সেসব গাছের পাতায় কাদা বা পলিমাটি লেগে থাকলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৭ দিন পর পরিষ্কার পানি স্প্রে করে পাতা ধুয়ে দিতে হবে।

৫. বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৮-১০ দিন পর ধান গাছে নতুন কুশি দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি ইউরিয়া এবং ৫-৬ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করুন। এছাড়াও গাছের বৃদ্ধি পর্যায় বিবেচনা করে অনুমোদিত মাত্রার ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োজন অনুযায়ী উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

৬. বন্যায় আক্রান্ত হয়নি এমন বাড়ন্ত আমন ধানের গাছ (রোপণের ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত) থেকে ২-৩ টি কুশি শিকড়সহ তুলে নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধান ক্ষেতে রোপণ করা যেতে পারে।

৭. বন্যামুক্ত বা বন্যা উপদ্রুত এলাকায় যেখানে আমন ধানের বেশী বয়সের চারা (সর্বোচ্চ ৬০ দিন বয়স্ক) পাওয়া যাবে তা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গোছাপ্রতি ৪-৫ টি চারা ঘন করে ২০ x ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে। উল্লেখ্য, শেষ চাষের সময় প্রয়োজনীয় টিএসপি (বিঘা প্রতি ১০ কেজি) ও এমওপি (বিঘা প্রতি ১৪ কেজি) সার প্রয়োগ করতে হবে এবং রোপণের ৭-১০ দিন পর বিঘা প্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

৮. বন্যা পরবর্তীতে ধান গাছে খোলপোড়া এবং পাতাপোড়া রোগ হতে পারে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহারসহ খোলপোড়া রোগ দমনে প্রোপিকোনাজল/নেটিভো/এমিস্টার টপ বিকাল বেলা অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। পাতাপোড়া রোগ দমনে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।

৯. বন্যা পরবর্তী সময়ে ধান ক্ষেতে পাতা মোড়ানো এবং বাদামি গাছফড়িং এর আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপক আক্রমণ হওয়ার পূর্বেই উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

১০. ধান, সবজি ও অন্যান্য দণ্ডায়মান ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করে ফেলুন।

১১. বন্যা কবলিত জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন সবজি চাষ করুন।

মৎস্য সেক্টরের জন্য পরামর্শসমূহ:

১. পুকুর বা জলাশয়ের পাড় ভেঙে গেলে দ্রুত মেরামত করুন বা ভাঙা অংশে জাল/বানা দিয়ে ঘিরে ফেলুন।

২. বন্যার পানির সাথে ভেসে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ পুকুরে প্রবেশ করলে তা ধরে ফেলুন।

৩. বন্যার পানি নেমে গেলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুকুরে পরিমাণমতো চুন এবং লবণ প্রয়োগ করুন।


প্রাণিসম্পদ সেক্টরের জন্য পরামর্শসমূহ:

১. বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বন্যা পরবর্তী সময়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের রোগবালাই যেমন- গরুর খুরা রোগ, গলাফোলা রোগ, তড়কা, বাদলা, হাঁস-মুরগির রাণীক্ষেত, ছাগল ও ভেড়ার পিপিআর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

২. গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের পরজীবী বা কৃমির আক্রমণ বাড়তে পারে।

সুতরাং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে গবাদিপশু ও হাঁসমুরগিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিষেধক টিকা প্রদান এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।

সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও কৃষকগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় উল্লিখিত বিশেষ পরামর্শসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে বন্যাক্রান্ত এলাকার কৃষি সেক্টরের ক্ষতি পুশিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। টেকসই কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যে ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অনুসরণ করার জন্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের কাছে তাঁদের উপযোগী ভাষায় সরবরাহ করা একান্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত পূর্বাভাস ও তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষকের উপযোগী করে বিদ্যমান আবহাওয়ার প্রেক্ষিতে স্থান ভিত্তিক কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ তৈরি করা হয় এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণ পদ্ধতিতে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি আবহাওয়া প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত বামিস পোর্টাল www.bamis.gov.bd ভিজিট করে বা Google Play Store/ App Store থেকে বামিস অ্যাপ মোবাইল-এ ডাউনলোড করে কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ পাওয়া যায়। এছাড়া কৃষি আবহাওয়া পরামর্শের জন্য নিকটস্থ উপসহকারী কৃষি অফিসার বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

লেখক:
ড. মোঃ শাহ কামাল খান
প্রকল্প পরিচালক,
কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা