ইলেকট্রনিক ভোটিং আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট প্রয়োগ বা সংশ্লিষ্ট ভোটারদের স্বীয় মতামত প্রতিফলনের অন্যতম মাধ্যম। এর অন্য নাম ই-ভোটিং। ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় এটি একাধারে সঠিকভাবে ভোট প্রয়োগ ও দ্রুততার সঙ্গে ভোট গণনা করতে সক্ষম। ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে উন্নত এবং উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে অতিদ্রুত ব্যালট পেপার গণনা করা সম্ভব। একই সঙ্গে অক্ষম ভোটাররাও তাঁদের ভোট সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। ভোট গ্রহণের স্থান হিসেবে ভোটকেন্দ্রেই মূলত ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ইন্টারনেট, ব্যক্তিগত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, টেলিফোন ব্যবহার করেও ই-ভোটিং প্রয়োগ করা সম্ভব। নতুনতর অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং পদ্ধতিতে পাঞ্চকার্ড, অপটিক্যাল স্ক্যানার ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার ব্যালট পেপারকে চিহ্নিত করে ভোট প্রদান করেন।
এতে একটি মেশিনে প্রায় চার হাজার পর্যন্ত ভোট দেয়া যায়। সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা থাকে। বাটন চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারে। একটি ভোট দিতে আনুমানিক ১৪ সেকেন্ড সময় লাগে। তবে একজন ভোটারের কোনভাবেই একটির বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে জাল ভোটের সম্ভাবনা উবে যায়। মেশিনটিতে একটি পূর্ব-প্রোগ্রামিং করা মাইক্রোচিপ থাকে যা প্রতিটি ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে হিসেব করে প্রদর্শন করে। এতে ব্যালট কাগজে সিল মারার পরিবর্তে ভোটার পছন্দের প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট দিতে পারেন। প্রতিটি বুথে একটি ইভিএমের প্রয়োজন পড়ে। এটি কয়েকটি ইউনিটে ভাগ করা থাকে। ইউনিটগুলো নিম্নরূপ-
১. ব্যালট ইউনিট: ব্যালট ইউনিটটি থাকে বুথের ভেতর। এর মাধ্যমে ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।
২. কন্ট্রোল ইউনি: কন্ট্রোল ইউনিট থাকে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে।
৩. ডিসপ্লে ইউনিট: ইভিএমের সঙ্গে একটি বড় ডিসপ্লে ইউনিট রাখা হয়েছে, যা এমন স্থানে রাখা হয় যাতে বুথের ভেতর ভোট-সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিগোচর হয়।
৪. ব্যাটারি ইউনিট: এই মেশিন চালাতে দরকার হয় ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি। ব্যাটারিতে মেশিনটি সারাদিন চলতে পারে ফলে বাড়তি কোন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না।
৫. স্মার্ট কার্ড ও মাস্টার কার্ড: একটি ভোটিং মেশিন পরিচালনা করার জন্য সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে একটি করে স্মার্ট কার্ড-ভিত্তিক আইডি কার্ড দেওয়া হয়, যে কার্ডটি ছাড়া কন্ট্রোল ইউনিট পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। ইউনিটগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও তারের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম পদ্ধতি চালু রয়েছে। এর প্রথম ব্যবহার হয় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথম ব্যবহার হয় ইভিএম। অনেকের মতে, সেটারই উন্নয়নের ফল আজকের ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম। এর পর কাগুজে ব্যালেট পেপারের পরিবর্তে আধুনিক এই ব্যবস্থা চালু করা যায় কিনা, এতে কী সুবিধা, কী অসুবিধা তা নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে আলোচনা হয়েছে। মেশিনটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সাধারণ ও রাজ্য সরকার নির্বাচনে ব্যবহৃত হয়। ১৯৮০ সালে এম.বি. হানিফা প্রথম ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় ভোটিং মেশিন আবিষ্কার করেন। পরে ১৯৮২ সালে ভারতের কেরালায় ব্যবহৃত হয়েছিল। বর্তমানে ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, নেদারল্যান্ড, পেরু, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে ইভিএম ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কেবলমাত্র সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে তা পালন করতে হবে। সাংবিধানিক এই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি অনুষঙ্গের কার্যকারিতা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করে চিহ্নিত বাঁধাসমূহ অপসারণ কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নততর পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার তাই কমিশনের কর্মকৌশলের অন্যতম প্রধান উপাদান। এই প্রেক্ষিতেই কমিশন বিগত ২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে।
আরেকটি দিক হলো, আমাদের অনেকের মাঝেই এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। তা হলো ইভিএম আর ই-ভোটিং দুটো এক বিষয় নয়। ই-ভোটিং হলো ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভোট দেওয়া। আর ইভিএম হলো ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম। এটি ভোট দেওয়ার ডিজিটাল মেশিন। ইভিএমে দুটি ইউনিট থাকে। একটি কন্ট্রোল ইউনিট। আর অন্যটি ব্যালেট ইউনিট। ব্যালেট ইউনিটে প্রার্থীর নাম এবং প্রতীক থাকে। একজন ভোটার তার স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে মাত্র একবারই ভোট দিতে পারেন। ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একজন ভোটারের স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে একবারই ভোটিং মেশিন চালু করতে পারেন। এবং ভোটারের ভোট দেওয়া সম্পন্ন হলে মেশিনটি বন্ধ হবে। একটি স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে একটির বেশি ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ইভিএমের আরও একটি বড় সুবিধা, ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর পরই ভোটের ফল জানা যায়। যেটি সুষ্ঠু নির্বাচনকে নিশ্চিত করতে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
ইভিএম ব্যবহারের আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধার কথা বলতে পারি। এরমধ্যে-ইভিএম ব্যবহারের ফলে কাগজ, ছাপা ও পরিবহন খরচ এবং ভোট গণনার সময় ও খরচ হ্রাস পায়। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি জাতীয় নির্বাচনে ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু ইভিএম পদ্ধতিতে একটি জাতীয় নির্বাচনে খরচ হবে মাত্র ৯`শ কোটি টাকা। একটি মেশিন দিয়ে তিন থেকে চারটি জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। মেশিনটিতে নতুন করে প্রোগ্রাম প্রবেশ করিয়ে একই মেশিন ব্যবহার করা যাবে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা উপ নির্বাচনেও।
ভোটের তথ্য মেশিনে প্রায় ১০ বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ভোটারের ভোট বাতিল হবে না।
১২ ভোল্টের ব্যাটারী চালিত বিধায় ইভিএম ব্যবহারকালে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেহেতু এটি একটি মেশিন এবং একজন ভোটার জাল ভোট দিতে অসমর্থ কাজেই একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ইচ্ছা করলেও একজন ভোটারকে একাধিক ভোট দানের সুযোগ করে দিতে পারবেন না। কেন্দ্র দখলের মতো ঘটনা ঘটলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ সুইচ চেপে দখলকারীদের অবৈধ ভোট দেয়া বন্ধ করতে পারবেন। ইভিএমের স্মার্ট কার্ড সরিয়ে ফেললে মেশিন চালু করা যাবে না। প্রতি মিনিটে ৫টার বেশি ভোট দেয়া যাবে না।
সর্বপরি সময় সংরক্ষণে ইভিএম-এ দ্রুত ভোট গণনার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। সুতরাং আগামীর যেকোনো নির্বাচনে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন ফলানোর জন্য একমাত্র ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম-ই পারে প্রযুক্তিনির্ভর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে। কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা নিয়ে ভিন্ন প্রযুক্তিতে এটি ভিন্নভাবে উদ্ভাবিত। নতুন এই মেশিনটির উদ্ভাবকদের সঙ্গে আগের মেশিনের উদ্ভাবকদের কোনো সংযোগ কিংবা আগের ইভিএম মেশিনের কোনো সম্পর্ক নেই।
তাই নতুন এই মেশিনে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না এবং ভোটের সময় ছাড়া এর আগে বা পরের দিনে বা রাতে কখনই ভোট দেওয়া যায় না। ভোটার আঙুলের ছাপ দিলেই কেবল ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়, অন্যথায় নয়। ব্যালট পেপার অন হওয়ার পর ভোটার তার ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তা আবারও অকেজো হয়ে যায় এবং অন্য একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না দেওয়া পর্যন্ত আর ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয় না। একজন ভোটার দ্বিতীয়বার ভোট দিতে চাইলে মেশিন নিজেই তাকে ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দেয়।
সম্প্রতি ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচন ইভিএমের ব্যাবহার করেছে নির্বাচন কমিশন। এতে পাঁচজন মেয়র এবং সাধারণ কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর মিলে ১৪৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথমবারের মতো ১০৫টি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ৬৪০টি কক্ষে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পরবর্তীতে বিএনপির দুই সাবেক নেতা ও নির্বাচনে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু এবং নিজাম উদ্দিন কায়সার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দিতে পেরে বিভিন্ন ভোটাররাও তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমে। ভোটারদের মতে, প্রচলিতভাবে দেওয়া ব্যালট বাক্সের ভোটের তুলনায় ইভিএমে ভোট দেওয়া সহজ। একইসঙ্গে কম সময় লাগার বিষয়েও জানান তারা। আবার তুলনামূলক কম সময়ে ভোট দিতে পারা এবং একইসঙ্গে প্রক্রিয়াটি সহজ হওয়ায় মাত্র ২২ থেকে ২৫ সেকেন্ডে ভোট প্রদান সম্ভব হওয়ায় এটি ভোটারদের স্বস্তি প্রদান করে। ফলে প্রক্রিয়াটি সর্বপরি প্রার্থী এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
তাই আগামীর সময়ে যেকোনো নির্বাচনে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মেশিনটির পারফরম্যান্স বা সিস্টেম হ্যাকিং করে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন কিংবা নির্বাচান প্রভাবিত করার কোন সুযোগ থাকছেনা এতে। কারন ইভিএমের সঙ্গে ইন্টারনেটের কোনো সম্পর্ক না থাকায় সেটি এই ঝুঁকি থেকে নিরাপদ। কাজেই, এখন সময় এসেছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যাবহার নিশ্চিত করার। সেইসাথে ইভিএমের কল্যানে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব এটিই প্রত্যাশা।
লেখকঃ ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।