শবেবরাত দুটি ফারসি শব্দ থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। শবেবরাতের আরবি ‘লাইলাতুল বারাআত’।
হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য রজনী’ বলা হয়েছে। এ মর্যাদামণ্ডিত রাত সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সূরা দুখান, আয়াত ১-৫)।
আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরিনরা বলেন, ‘এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুফাসসির মুফতি শফি রহ. তার তাফসিরে লিখেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ছাত্র ইকরিমাসহ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সূরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবেবরাতকে বোঝানো হয়েছে।’ (মাআরিফুল কোরআন।)
শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক সহি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি রহমতের নজরে তাকান। অতঃপর মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর-৬৬৪২।)
এ ছাড়া শবেবরাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ গ্রন্থে ইমাম বায়হাকি রহ. দারুণ একটি হাদিস বর্ণনা করেন। হজরত আলা ইবনুল হারিছ রহ. থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা. রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম।
তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।
নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত।) আল্লাহতায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান।)
এ হাদিস প্রমাণ করে শবেবরাতের রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া রাসূল সা.-এর পছন্দনীয় আমল। আর তিরিমিজি শরিফে হজরত আলী রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা ১৫ শাবানের রাতে নামাজে দাঁড়াও এবং দিনে রোজা রাখ।’ বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, এ রাতে রাসূল সা. কবর জিয়ারতও করতেন।
কেউ কেউ শবেবরাতের ফজিলত মানতে চান না। অথচ শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘১৫ শাবানের রাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক ‘মারফু’ হাদিস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দিয়ে ওই রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
সালফে সালেহিনের বড় একটা অংশ এ রাতের নফল নামাজের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহিহ হাদিসগুলোই রয়েছে।’ ইমাম আহমাদ রহ. এর মতোও তাই। কেননা এর ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সাহাবি ও তাবেয়িদের বক্তব্য বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদিসের কিতাবে এমনকি কতক ‘সহিহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহিহ ইবনে খুজাইমা ও সহিহ ইবনে হিব্বান কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম ইবনে রজব রহ. তার ‘লাতায়েফুল মাআরেফ কিতাবে শবেবরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে বলেছেন, ‘একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে জিকির ও দোয়ার জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া।
প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দোয়া করবে এবং নফল নামাজ পড়বে। সবসময় সেসব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ওই রাতের বিশেষ ফজিলত থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, জিনা, হিংসা ইত্যাদি।’ আল্লাহতায়ালা আমাদের বোঝার তৌফিক দিন। আমিন।
টিএইচ