সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
The Daily Post

বিভিন্ন দেশে রোজার রীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভিন্ন দেশে রোজার রীতি

মুসলিমদের জন্য আরবি বর্ষপঞ্জিকার নবম মাস রমজান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে রোজা, যা এ মাসেই পালন করা হয়। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী রোজা রাখা হলেও সংস্কৃতিভেদে বিভিন্ন দেশে কিছু আলাদা রীতি পালন করা হয়ে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কিছু রীতি নিয়েই এই প্রতিবেদন।

তুরস্ক ও আলবেনিয়া : রমজানের সময় সাহরির আগে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলা বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। কোনো কোনো এলাকায় তরুণদের হাঁক-ডাকে মুসলিমদের জাগানোর প্রথাও বেশ পুরোনো। অনেকটা একই রকম প্রথা চালু আছে বিশ্বের আরেকটি মুসলিমপ্রধান দেশ তুরস্কে। অটোমানদের মতো তুর্কিরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ‘দাভুল’ নামের বড় আকারের ঢোল পিটিয়ে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলে। দুই দিকেই বাজানো যায় এমন ঢোল নিয়ে শহরজুড়ে ঘুরে ঘুরে সাহরির জন্য মানুষদের জাগিয়ে তোলা হয়। এর বিনিময়ে বখশিশ পায় তারা। এ সময় সাহরিতে জেগে ওঠা মুসলিমরা একসঙ্গে খাওয়ার জন্য তাদের ডাকও দেয়। অনেকটা একই চর্চা আছে আলবেনিয়ার রোমা মুসলিমদের মধ্যে। ভেড়া বা ছাগলের চামড়ায় আবৃত লোদ্রা নামের ঐতিহ্যবাহী ড্রামের সঙ্গে বিশেষ গীতিনাট্য দিয়ে তারা রমজানে দিনের শুরু এবং শেষ করে।

মিসর, জর্দান ও মরক্কো : মিসর ও জর্দানে সাহরির আগে এলাকাভিত্তিক কিছু মানুষ প্রতিবেশীদের ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য ডাকেন, যাদের বলা হয় মেসাহারাতি। তাদের কাজ হচ্ছে আশপাশের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য ডাক দেয়া। ঢোলের মৃদু শব্দের সঙ্গে তারা ডেকে দেয়ার কাজটি করেন। একই কাজ করা লোকদের মরক্কোতে ডাকা হয় নাফারস নামে। এ সময় তারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গান্দোরা’, টুপি এবং একজোড়া চপ্পল পরে প্রার্থনার সুরে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকেন। সাধারণত শহরের লোকেরাই ‘নাফারস’ হিসেবে কয়েকজনকে নির্বাচন করেন। 

রমজানের শেষ রাতে মরক্কোর এই দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য এই ব্যক্তিদের সম্মানী দেয়া হয়। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে রঙিন এবং সুন্দর রমজানের ঐতিহ্যগুলো মধ্যে একটি মিসরের ‘ফানুস’। এটি মূলত ধাতু ও রঙিন কাচ দিয়ে উজ্জ্বল রঙের প্রদীপ বা লণ্ঠন। ধারণা করা হয়, এই ঐতিহ্যের উৎপত্তি ফাতেমীয় সাম্রাজ্য থেকে শুরু হয়েছিল, যখন খেলাফত আল-মুই লি-দিন আল্লাহ কায়রোতে আসার সময় তাকে রঙিন লণ্ঠন দিয়ে স্বাগত জানানো হয়।

মিসরে রমজানের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রাস্তা, বাড়ি এবং পাড়া এই লণ্ঠন দিয়ে আলোকিত করা হয়। স্বতন্ত্র নকশা এবং বিচিত্র কারুকার্যের জন্য পরিচিত লণ্ঠন বৈশ্বিকভাবে মিসরীয় রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ইরাক : রমজানে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে সারাদিনের সংযমের সঙ্গে ইফতারের পর হালকা মজা করায় কোনো ক্ষতি নেই বলেই মনে করেন ইরাকিরা। আর তাই এ সময় তারা খেলেন দেশটির অন্যতম প্রধান একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা ‘মেহাবেস’। একে আংটি খেলাও বলা হয়ে থাকে।

৪০ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত খেলাটিতে অংশ নিতে পারে। এ সময় অংশগ্রহণকারীরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়। পালা করে একটি দল আংটি লুকিয়ে রাখে এবং অন্যদলের সদস্যদের ধারণা করতে হয় যে আংটিটি কার কাছে আছে। বাড়ির বাইরে কেবল পুরুষরা অংশ নিলেও, ঘরের ভেতর নারীরাও এই খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। ইরাকিদের কাছে এই খেলা সবার একত্রিত হয়ে কিছুটা আনন্দে কাটানোর মাধ্যম। যুদ্ধের কারণে অনেক বছর খেলাটি বন্ধ থাকলেও ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় আবার ফেরত আসছে।

লেবানন : কামানে তোপধ্বনি দিয়ে ইফতারের সময় হওয়ার বিষয়টি জানানো হয় লেবাননে। এটি সম্ভবত বিশ্বে প্রচলিত রমজানের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের একটি। এটি শুরু হওয়ার প্রায় ২০০ বছর পরও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ আজও এই চর্চা চালু রেখেছে, যা ‘মিদফা আল ইফতার’ নামে পরিচিত। তবে এই প্রচলন সবসময় লেবাননের রমজানের ঐতিহ্যের অংশ ছিল না। 

বলা হয়ে থাকে, মিসর থেকে এই প্রথার উদ্ভব। কোনো এক রমজান মাসে তৎকালীন শাসক খোশ কদম ঘটনাক্রমে সূর্যাস্তের সময় কামানের একটি গোলা ছোঁড়েন। এর শব্দ কায়রো শহরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয় এবং জনগণ একে রোজা শেষ হওয়ার সংকেত হিসেবে ভুল করে। তবে এই ভুলকেই সবাই খুব প্রশংসা করে এবং শেষমেশ কামানের তোপধ্বনি ঐতিহ্যে পরিণত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ‘মিদফা আল ইফতারকে’ ইফতারের সময় হওয়ার আনুষ্ঠানিক সংকেত হিসেবে গ্রহণ করেছে। লেবাননে ১৯ শতকের বিশেষ এক কামানই রয়েছে, যা বর্তমানে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহূত হয়। ১৯৮৩ সালে লেবাননে আক্রমণের পর কামানকে অস্ত্র হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে ঐতিহ্যটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর লেবানিজ সেনাবাহিনী এই প্রথা পুনরুজ্জীবিত করে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও সাহরি ও ইফতারে কামানের তোপধ্বনি দেয়া হয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত : রমজান শুরু হওয়ার আগেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে চালু হয় ‘হক আল লায়লা’ নামের এক বিশেষ আয়োজন। রমজানের ঠিক আগের মাস, অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখে। এই দিন শিশুরা রঙিন কাপড় পরে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যায়। এ সময় তারা খারিতা ব্যাগে মিষ্টি সংগ্রহ করে এবং সুর করে বলে ‘আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইউদিকুম’, যার অর্থ ‘আপনারা আমাদেরকে দিন, আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কা পরিদর্শনের তৌফিক দেবেন।’

বছরর পর বছর ধরে ধর্মীয়ভাবে চর্চা করা ‘হক আল লায়লা’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজান পালনের ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হল রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কুয়েতেও এটি পালন করা হয়। তবে তা হয় রমজানের মাঝামাঝি সময়ে তিন দিনের উদযাপন। এ সময় শিশুরা তাদের আশপাশের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে থাকে এবং মিষ্টি ও চকলেটের জন্য গান গায়। এই ঐতিহ্যটিকে ‘গারগিয়ান’ বলা হয়।

ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মুসলমানদের জন্য রমজানের আগে নিজেদের শুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি ‘পাদুসান’, যার অর্থ গোসল করা। রমজান শুরুর আগে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা তাদের আশপাশের প্রাকৃতিক পুকুরে গোসল করে এবং নিজেদের পরিষ্কার করে। এই সাংস্কৃতিক চর্চা রমজান মাসে বিশ্বাসীদের শুদ্ধ করে বলে মনে করেন মুসলিমরা। তবে ইদানিং অনেকেই নিজ বাড়িতেই এই গোসল করে নেন।

দক্ষিণ এশিয়া : রমজানের শেষ সন্ধ্যা, যা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ‘চাঁদ রাত’ নামে পরিচিত। রমজানের শেষ দিন শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠার পর উৎসবের আমেজ দেখা যায়। এটি বাংলাদেশে চাঁদরাত হিসেবে পরিচিত। এই চাঁদরাতে ঈদের আগে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা চলে। উৎসবের অংশ হিসেবে নারীরা হাতে মেহেদি লাগায় এবং নানা আয়োজন করে। তবে এই আয়োজন শহর এবং গ্রামের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়।